এতদিন
পর্যন্ত যাদবপুর-বিষয়ক চর্তমান আন্দোলনের যে চেহারা ও শক্তি ছিল তা এবার থেকে কমতে
শুরু করবে বলেই আমার আশংকা হচ্ছে, তাতে অত্যাচারি ও
শাসকেরই জয় হবে।
"আগের সরকারের" ইতিহাসতো অনেক বড়, অনেক দীর্ঘ, মাত্র শেষ এক দশকের বা দু দশকের না।
এমনকি মাত্র চৌত্রিশ বছরেরও না। সে ইতিহাস শেষ এক বা দু দশকের বিস্ময়কর বিচ্যুতির
মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। বরং তার আগের সরকারের এহেন জনবিরোধী ভূমিকার ইতিহাস অনেক বেশি
দীর্ঘ,
অনেক বেশি নৃশংস, অনেক বেশি পৈশাচিক, অগ্ণতান্ত্রিক, অনেক বেশি স্বৈরতান্ত্রিক। সেই দীর্ঘ সময়ের ছাত্র আন্দোলনের
সংগঠক কারা ছিলেন ? বর্তমানের
যাদবপুর/প্রেসিডেন্সির ক্রমশ ক্ষীণ হতে চাওয়ার ভুল পথে যাওয়া নেতৃত্ব সে ইতিহাস
একটু ঘেঁটে দেখলে ভাল করবেন। সে সময়ে কিন্তু সার্বিক ঐক্য গড়ে তুলেই স্বৈরতন্ত্র
বিরোধী আন্দোলন , ছাত্রের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে আন্দোলন করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও চাই
সবরকম দাম্ভিকতা, অগণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র জনবিরোধী আচরনের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ, কিন্তু এই খসড়া প্রস্তাবে মনে হচ্ছে সে বৃহত্তর ঐক্য ভেঙে
যাবে।
"মাওবাদী" প্রসঙ্গ ...... আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যে মাওবাদীরা ছিল এবং আছে এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। মাওবাদীদের
কথা "নন্দীগ্রামের আন্দোলন" থেকে শুরু নয়। তারও আগে থেকেই তথাকথিত
মাওবাদীদের দ্বারা সাধারণ মানুষ ও বাম আন্দোলনের কর্মী-নেতা-শিক্ষক তাঁরা
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে না নামলেও তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। সম্মুখ
সমরে কিংবা গেরিলা লড়াইতেও প্রধাণ শত্রু শিবিরের সৈনিক ও সেনা নেতৃত্বকে হত্যা করা
হয়ে থাকে। তার অন্যথা একমাত্র আমাদের দেশেই ঘটতে দেখসছি।
বর্তমান
শাসকেওদের এই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতায় এনে দেওয়ার এক বিরাট শক্তি হিসেবে সমাজের
নানা অংশ,
নানা রাজনৈতিক দল কাজ করেছে। তাঁদের মধ্যে সশস্ত্র
মাওবাদীরা যে ছিলেন এটা মাওবাদীরাও অস্বীকার করেন না। তাঁরাই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রিকে
যোগ্য মুখ্যমন্ত্রি মনে করেছিলেন। এই মুখ্যমন্ত্রি সে সময়ে মাওবাদীদের অস্তিত্ব
অস্বিকার করেছিলেন আর ক্ষমতায় আসার পর সেই মাওবাদীদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষনা
করলেন। এও ইতিহাস।
আমার এবং
আমার মত অনেকেরই একদিকে যেমন যাদবপুরের এই আন্দোলনে সমর্থন রয়েছে, এবং সেটা শুধুমাত্র বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে হচ্ছে বলে নয়, বরং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে হচ্ছে বলে। আমি সশরীরে অংশগ্রহণ
করতে না পারলেও আমার মত অনেক মানুষ এমনকি আগের সরকারের হাজার হাজার সমর্থক এই
আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, বৃষ্টিতে ভিজে
আপনাদের মতই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিছিলে হেঁটেছেন। তাঁদেরকেও এই আন্দোলনে রাখা প্রয়োজন, রাখতে চেষ্টা করতে হবে। তেমনই ওদেরও চেষ্টা করতে হবে একসাথে
থাকার। আজ এবং আগামীদিনে গণতান্ত্রিক মানুষের, শোষন-অত্যাচার থেকে মুক্তির আন্দোলনে চিরকালই এই বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন।
আজকের যুগের
বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতির আলোকে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা হল, মানুষের মুক্তির আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন কোনোদিনই শেশ হয়না, চলতেই থাকে। যখনই কোনো শক্তি তা সে কোনো এক যুগে যতই প্রগতিশীল হোক তারা
ক্ষমতায় এলে নিজেদেরকে ক্রমশ একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। আর সর্বনাশটা এখানেই
লুকিয়ে থাকে। তাই মুক্তির আন্দোলন চিরকালীন। অত্যাচারিতের বৃহত্তর ঐক্য চিরকালই প্রয়োজন, বেশি বেশি করে প্রয়োজন। একথাটা সবাইকেই বুঝতে হবে। জেদ বা গোঁ এবং সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলতে হবে।
আগের সরকার
ও ত্তার নেতৃত্ব শেষদিকে নিজেদেরকেই একটা সর্বশক্তিমান নির্ভুল প্রতিষ্ঠান বলে মনে
করতেন। সেই প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে গিয়ে যাদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপন করা হ'ল সেটা যে কত বড় ভুল তা নিজেদের বুঝতে হবে, মানুষকে বোঝাতে হবে। এ ভুলটা কাম্য ছিলনা।
তাই আমার ও
আমার মত মানুষদের আবেদন যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ে, প্রতিটি জনবিরোধী
ঘটনায় মিত্র শক্তির বৃহত্তর ঐক্য বজায় রেখেই আন্দোলন করতে হবে।
আমরা বরাবরই
দেখেছি,
আমাদের দেশে বিশেষত আমাদের রাজ্যে বামশক্তি ক্ষমতায় থাকলেই
অতিবামেরা তাঁদের আন্দোলন তীব্র করেন এবং প্রধাণত বামেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ নামিয়ে
আনেন ও এই প্রয়োজনে ডানপন্থী শাসকদের সাথে মৈত্রি স্থাপন করেন। এর ফল শুধু মাত্র
বামপন্থীদের ক্ষতি করেছে তাই নয়, বামপন্থীরা দূর্বল
হয়ার পর সেই দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী শাসকেরা অতি বামদের আরও নৃশংসভাবে শেষ করতে
উদ্যত হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এবং সর্বশেষ বরানগর-কাশীপুরের ঘটনা তাঁদের
মনে আছেতো ! এত শেখার পরেও তাঁরা পথ পরিবর্তন করবেন না ?
আবার
বিপরীতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথেই সমাধানের আশায় এবং বিশ্বাসে বামপন্থীরা মাঝে মাঝেই
দক্ষিণপন্থী এমনকি অতি দক্ষিণপন্থীদের সাথেও মৈত্রী গড়েছে। ন্যূনতম কর্মসূচীর কথা
বলে তাঁরা দক্ষিণপন্থীর নেতৃত্বাধীন সমন্বয় কমিটিতে যোগ দিয়েছেন। সেই কমিটির
পরিচালক ও নীতি নির্ধারক ছিলেন দক্ষিণপন্থীরা।এ ঘটনা আমরা যেমন ৭০-এর দশকে দেখেছি
তেমনই দেখেছি কেন্দ্রে যুক্ত মোর্চার সরকারে এবং সর্বশেষ দেখেছি দ্বিতীয় ইউপিএ
সরকারের সময়ে। চূড়ান্ত সময়ে দেখা গেহে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তাদের চরম স্বার্থ
রক্ষার সময়ে নিজেদের ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নিয়েও বামেদের ত্যাগ করতে প্রস্তুত
থাকে। এসবের পরেও বামেরা তাদের সাথে যাবেন ?
অনেকের সাথে
আমি সহমত যে, বামপন্থী আন্দোলনের এই সমস্ত শাখা
প্রশাখা যদি মাঝে মাঝেই জনস্বার্থের কথা তুলে এবং ন্যূনতম গণমুখী কর্মসূচীর কথার
আড়ালে দক্ষিণপন্থী শক্তির সাথে মৈত্রী গড়তে পারে তবে তাঁরা সে পথ ত্যাগ করে
বৃহত্তর বাম ঐক্য কেন গড়তে পারবেন না?
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, প্রথম যুক্তফ্রণ্ট আমলে বর্ধমানে সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড নিয়ে শোষক শ্রেণীর প্রচারকদের সাথে এক হয়ে আমাদের এখানকার অতিবামপন্থীরা (যাঁরা নাকি শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাস করেন) তাঁরাও সে সময়ের কৃষক আন্দোলনের বাম নেতৃত্বের বিরোধিতা করেন। অথচ তাঁরাই আবার জোতদার-জমিদারদের হত্যা করেছেন, শ্রেণীশত্রু তকমা লাগিয়ে গ্রাম-শহরে শ্রেণীমিত্রদের হত্যা করেছেন। এ অদ্ভূত বৈপরিত্য যখন দেখি তখন এটাই বিশ্বাস করতে মন চায় যে শোসক শ্রেণী ও অতিবামপন্থীরা আসলে পরস্পরের মিত্র। আমাদের সময়তেই কার্যত এ ঐক্য আমরা দেখেছি। যাঁরা শ্রেণীর অস্তিত্ব ও শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাস করেন তাঁরা তো জানেন পুঁজিবাদ, জোতদার-জমিদার বা
শোসক শ্রেণী শ্রেণীসংগ্রাম ব্যাতিরেকেই কত নৃশংস হয়। এও জানেন যে কোনো
যুদ্ধে দুপক্ষেরই যোদ্ধার মৃত্যু অনিবার্য। রুশ বিপ্লব, চীন বিপলব, কিউবা, কোরিয়া, ভিয়েতনাম কোথো এর
অন্যথা হয়নি। শ্রেণী সংগ্রামের যে কোনো স্তরেই এটা হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে শ্রেণী
সংগ্রামের একটা পর্যায়ে সাঁইবাড়ির ঘটনাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করবেন।
যদিও ৯০ থেকে ১০০ জনের মৃত্যুর ঘটনা সত্য বলে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এমনকি এই
হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার তারাও একথা বলেনি।
দ্বীতীয়ত
বরানগর-কাশীপুর হত্যাকাণ্ড প্রসং। ঘটনা চক্রে আমি তখন সি পি আই (এম) এর সদস্য।
বাড়ি ছাড়া, এখানে ওখানে থাকি। বরানগর-কাশীপুর
অঞ্চলেও সি পি আই (এম) অনেক আগে থেকেই এলাকা ছাড়া হয়েছিল। ঐ অঞ্চলের বহু সদস্য
জেলে ছিল। এমতাবস্থায় চি পি আই এম-এর নেতৃত্বে বরানগর-কাশীপুরের গণহত্যা চালানোর
কথা হাস্যকর এবং অবাস্তব। বরং আমরা এ ঘটনায় আতংকিত ও চিন্তিত ছিলাম। তখন আমাদের
প্রকাশ্যে আন্দোলন করা সম্ভব ছিলনা। কিন্তু আমাদের মধ্যে এটা আলোচনা হয়েছিল।
১৯৭৭-এর পর এই হত্যা বিরোধী কমিটির নেতৃত্বে যতগুলি কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে
প্রতিটিতে সি পি সি এম অংশগ্রহণ করেছে। নকশাল পার্টির নেতৃত্ব এসব কথা ভালভাবেই
জানেন। বন্দীমুক্তির সিদ্ধান্তের ফলে শুধুমাত্র সি পি আই এম বদীরাই মুক্তি পেয়েছে
তা নয়,
নকশাল পার্টির বহু নেতা ও কর্মীও মুক্তি পেয়েছেন। আপনার মত
মানুষ পুঁজিবাদী প্রচারে বিশ্বাস করবেন এটা ভাবতে কষ্ট হয়।
তৃতীয়ত ঃ-
বর্তমান সময়ে এসব কথা আমি উত্থাপন করতে চাইনি। আমার এসব কথা উত্থাপন করার
বিন্দুমাত্র ইচ্ছে কোনোদিনই ছিলনা। কিন্তু বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট
আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখে পথ খুঁজছি নিজে সান্তনা পাওয়ার জন্য। আমি বৃহত্তর বাম
ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। মতাদর্শগত পথ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব
করি। কদিন আগের আমার লেখাপত্তর/মন্তব্য দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। আজকালের মধ্যে
আমার আশংকা সত্য করে যে কথাগুলো নানা জায়গায় উঠে এল তাতে আমি আশংকিত যে বর্তমান
সময়ে যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শ্রেণী
সংগ্রাম সম্পর্কে অতীতের মতই ভুল ধারণা এবং সিদ্ধান্তর কারনে। শ্রেণী সংগ্রাম বলতে
আমি কখনই মনে করিনা যে, প্রতিক্রিয়াশীল
শক্তিবিরোধী একাধিক সংগঠন তারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিক্রিয়ার সংগে হাত মিলিয়ে
মিত্রশক্তিকে আঘাত করবে। আমি একথাও
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, মিত্রশক্তিকে
কোনঠাসা করার জন্য শ্রেণীসংগ্রামের কোনো হত্যাকাণ্ডকে তুলে আনা উচিত।
আমি সমস্ত
বিষয়টা নানা দিক থেকে বিচার করে সত্য-মিথ্যা ঠিক-ভুল শত্রু-মিত্র বুঝে নিতে চেষ্টা
করি। আমি গত ছাব্বিশ বছর যাবত কোনো দলীয় রাজনীতির সংগে যুক্ত নই, কোনো দলীয় রাজনীতিক কর্মসূচীকেই সমর্থন করিনা। এসব নিয়ে
আমার অনেক প্রশ্ন আছে, বিতর্ক আছে। আমি
চাই একটা বৃহত্তর ঐক্য সবাই গড়ে তুলুক, যদিও জানি আমরা কয়েকজন মানুষ চাইলেই তা হবে না। তবু চাইতে দোষ কি, তাই এত
কথা বললাম।