এ ক'দিন রাজনীতি নিয়ে অনেকের লেখা পড়লাম,। আমি একটু অন্যভাবে শুরু করি। আমার এই লেখাটা রম্যরচনার জন্যপ্রিয় পত্রিকা 'রসাতল'-র নেশা সংখ্যা (সংখ্যা সাত, অগাষ্ট ২০১২) তে প্রকাশিত লেখা। এই সময়ে এখানে তুলে দিলাম, তারপর এখনকার কথায় আসব।
>>>>>>>>>>>>>>>>
শা'......
শা’... কোন বাজে কথা নয় মানে বিশেষ সূত্রে গড়ে ওঠা সম্পর্ক উচ্চারণে গালাগাল নয়, শুধু দুটো অক্ষরের সম্মেলন মাত্র। আগে বসলে শাপ-শাপান্ত থেকে অনেক কথা, শেষে বসলে পেশা থাকে পাশা, নেশা থেকে নাশা এমনও অনেক। তবে সর্ব নেশাই সর্বনাশা নয়। যেমন রসাতলের সম্পাদনা এ্যাডিকশন নয়, প্যাশন। প্যাশন যে সর্বনাশা হয়না তা’ নয়। প্যাশনও শারীরিক, মানসিক, বৈষয়িক-সামাজিক নানা ক্ষেত্রেই সর্বনাশা হতে পারে। নেশা নানা কারণে ও সুযোগে পেশা হয়েও দাঁড়ায়, যেমন রাজনীতি। প্রকৃত রাজনীতিকরা এটা নিয়ে গর্ব করেন। এ নেশাটাও এ্যাডিকশন নয় প্যাশন, রাজনীতির প্রতি পূর্ণ আসক্তি নিয়ে ‘নেশাচ্ছন্ন” থাকা।
‘নেশাচ্ছন্ন’ বললে ঠিকঠাক বোঝা যায়, কারণ “বিপিন বাবুর কারণ-সুধা মেটায় জ্বালা মেটায় ক্ষুধা”। রাজনীতির নেশার ক্ষেত্রেও তাই। সেটা মননশীল, সৃজনশীল, ধ্বংসাত্মক, অনর্থক যাই হোক না কেন ব্যক্তিবিশেষের নানা রকম ক্ষিদে মেটে। এছাড়াও উত্তেজিত হওয়া যায়, এমনকি কখনো কখনো কেউ কেউ বেসামালও হয়ে পড়েন। মোট কথা কোনো কারণে বা কোনো কাজে বোধে বা নির্বোধে, স্বার্থে বা পরার্থে জীবনপাত করে আচ্ছন্ন বা বুঁদ হয়ে থাকলেই হল।
তা, রাজনীতির নেশার কথা বা নেশার-ঝোঁকে রাজনীতির কথা বলতে গেলে নেশাচ্ছন্ন কমলাকান্তের কথা মনে পড়বেই। অবশ্য দুগ্ধলোভী মার্জারের সাথে তাঁর নেশাতুর কথোপকথন পুনরুল্লেখ না করাই বেশি নিরাপদ। তিনি যা করে গেছেন আজকের দিনে তা করতে গেলে “এখনই ‘ফতোয়া’ ‘কণ্ঠরোধ’ এসব বলছেন, শেষে কী বলবেন” এর আওতায় জেল খাটতে হতে পারে। “নিষেধাজ্ঞা” শেষে নেতা-নেত্রীর ‘চাওয়া’ মানে ‘অনুরোধ’ মানে ‘নির্দেশ’। ফলে প্রথমে সামাজিক ভাবে ত্যাজ্য পরে আইপিসি তারপর ইউএপিএ আছে, আফস্পা আছে। এস্মা, নাসা, মিসা এগুলো অনেক পুরনো হয়ে গেছে। “যে সব লোকে পদ্যা লেখে,/তাদের ধরে খাঁচায় রেখে......” ‘পদ্য’ একটা প্রতিরূপ। ওটা কার্টুন, কোলাজ, হুশেনের ছবি কিংবা লালনের গান যা কিছু হতে পারে। আমাদের স্বাধীন দেশে নজরুল রবীন্দ্রনাথের গানও শেলফের বাইরে বের করা নিষেধ হয়েছিল, কারণ নিজের রাজনীতিটা আগে। ও নেশা ভং হতে দেব না, অন্য নেশা (রাজনীতি) করতে দেবনা, কেউ সে চেষ্টা করলে ‘দেখে নেব’ এবং ‘শেষ দেখে ছাড়ব’। এঁরা উত্তেজিত এবং সময়ে-অসময়ে বেসামাল হন কারণ রাজনীতি তাঁদের নেশা। কমলাকান্ত উত্তেজিত হতেন না কারণ নেশাটা ছিল তাঁর রাজনীতি।
নেশার ঘোরে বেসামাল কথাবার্তায় যাওয়ার আগে গুরু-বন্দনার মত রাজনীতির বন্দনা সেরে নিই। ধর্মীয় নেশার পর একমাত্র রাজনীতির নেশাই বিশ্বশ্রেষ্ঠ, বিশ্ব নিয়ন্ত্রক, বিশ্বপ্রিয় দীর্ঘস্থায়ি নেশা মাত্র। এ নেশাই একমাত্র যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা, লেখালেখি, কথাবার্তা, বিতর্ক, যুদ্ধ, প্রাণহানি হয়েছে এবং নেশা নিয়ে এটাই একমাত্র ইন্ডাস্ট্রি যেখানে কোটি কোটি মানুষ সাধারণত স্বেচ্ছায় অর্থ, শ্রম, বিষয়-আশয়, প্রাণ দান করে। বেশিরভাগ মানুষের এই দান মুখ্যত পরার্থে আর একমাত্র এই ইন্ডাস্ট্রিরই অন্যতম বড় সাব-ইন্ডাস্ট্রি হল যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ কারখানা। বন্দনা শেষে বুকটা বেশ ফুলে ওঠে। লেফ্ট-রাইট-লেফ্ট, লেফ্ট-রাইট-লেফ্ট......হেই-ই-ই-ল...হুপ্।
তা’ রাজনীতির প্রকৃত নেশাড়ুরা রাজনীতি করাকে দেশ-সেবার কর্তব্য বলে মনে করেন এবং একাংশ, বিশেষত যারা নেতা-নেত্রী তাঁরা দেশসেবার রাজনীতিকেই তাঁদের পেশা হিসেবে বেছে নেন। এটাই তাঁদের নেশা। খানিকটা ভুতে পাওয়ার মত অবস্থা। আর যারা শুরু থেকেই হোক কি পরেই হোক লাভের জন্য রাজনীতি করেন তাঁদের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, তাঁরা রাজনীতি-ব্যবসায়ী, ব্যাবসায়ী-রাজনীতিক। এঁরা নেতাদের তোষামোদ করা, জনগণকে সচেতনভাবে বিভ্রান্ত করা (প্রতারকের মত), যতটা সম্ভব ছদ্মরুপে নানাবিধ লাভের পথকে সুগম করা ইত্যাদিতে সুচতুরভাবে ব্যস্ত থাকেন। এটা তাঁদের নেশা নয়, উপার্জনের হাতিয়ার। নেশা ধরলেই বরং তাঁদের সাড়েসর্বনাশ ! এর পরের রাজনীতিক হলেন আংশিক সময়ের একদল রাজনৈতিক কর্মী যারা মানুষের মঙ্গলের আশায় নেতাদের নির্দেশে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন, বিরোধী পক্ষকে সহ্য করতে পারেন না। তাঁদেরও এটা নেশায় পরিণত হয়, এঁরাই সংখ্যায় বেশি। এঁদের নেশাগ্রস্ত করার কাজটা সুচারু রূপে হয়না বলে অনেক ক্ষেত্রেই এঁরা যথেষ্ট অনিয়ন্ত্রিত। আরেক দল আছেন যারা প্রধানত নিজেকে সমাজের মান্যগণ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এটাকে মাধ্যম করেন। তাঁদের রাজনীতি না করলে চলেনা ঠিকই কিন্তু তাঁদেরও এটা নেশা নয়। এখানেই কি শেষ ? না, এত অল্পেতেই অধীর হলে নেশা হয় না। অনেকেই ইচ্ছে না থাকলেও অন্য নানবিধ কারণে রাজনীতি করেন। তাঁদের কাছে রাজনীতিটা নেশাও না, পেশাও না, তাঁরা খানিকটা পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই রাজনীতি করেন। তা কখনো চাকরি বাঁচানোর জন্য, কখনো পিঠ বাঁচানোর জন্য। কখনো ত্রাণ পাওয়ার জন্য, কখনো ত্রাণ-সাহায্য পাওয়ার জন্য, কখনো অবসর সময় কাটানোর জন্য। তা ছাড়া “ঢুক্যে প্যরেছি বের্রিয়ে যাব্বো কোথায় বলো” গোত্রের লোকজনও আছেন। “হ্যাঃ, আরেন্না জনগণতো শুধু জনগণনার জন্য”। আমার এসব যাবতীয় কথাবার্তার মূল উদ্দেশ্য শুধু যারা নেশাগ্রস্তের মত রাজনীতি করে আমেজে বুঁদ হয়ে থাকেন রসাতলে পাঠাবার জন্য তাঁদের বেছে নেওয়া। এঁরা কী কী ভাবে বুঁদ হয়ে থাকেন?
(১) সমস্যা সমাধানে তত্ত্ব সন্ধানের নেশা। জিনিসপত্তর শরীর আর রসাদি ( আদি নয়) সংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের কথা বাদ দিলে মানুষের জীবনের বাকি সব সমস্যার সমাধানের জন্য ( আজ অবধি হয়নি) চিরকাল কিছু মানুষকে দার্শনিক নামক ভুতে পায়। এঁরাই রাজনীতি-নেশার সর্বোচ্চ শিখরে আছেন, যেখানে মহাদেবের জটা আছে ! ওঁদেরও আছে। দর্শনের নেশা মানে সব দেখে-শুনে এক-দ্বি-ত্রি ইত্যাদি স্তরেও কুলোয় না বলে বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে, মাথায় টাক ফেলে, পকেটের টাকা ফেলে, অথবা বড় বড় চুল-দাড়ি রেখে খণ্ডের পর খণ্ড ইয়া মোটা মোটা বেশ ভারি ভারি বইতে কঠিন কঠিন সব কথা লিখে যাবতীয় সমস্যা সমাধানের আর মুক্তির পথ বাতলে দেওয়া। পণ্ডিতের কথা তো, ফেলা যাবে না।
সহজ সমাধান অবশ্য একটা আছে, “যত মত, তত পথ”, কিন্তু মুস্কিল হল, “...আমড়াতলার মোড়ে/তিন মুখো তিন রাস্তা গেছে, তারই একটা ধ’রে... পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে...”।
কোনো কোনো দার্শনিক আবার এও বলেন, তাঁদের দর্শন ‘ডগমা’ নয়, মূল সূত্রগুলো ঠিক রেখে দেশকাল ভেদে আর সব পালটে নেওয়া যেতে পারে। বোঝো কাণ্ড ! এই সুযোগে আজকাল ত অনেকে সবই পালটে ফেল্লো। প্রায় নতুন করে লেখা হল, মূল সূত্রগুলো সমেত ! পাতা উলটে মনে হল সবটাই উলটো, এতদিন যা শুনে বুঝে বলে এসেছি সেসবে বস্তা বস্তা ভুল ! থাকতেই পারে। মাথায় বোঝা চাপানোর সময় আমরা আবেগের তোড়ে যদি না বুঝি যে বস্তায় কী আছে, ভুল নোট না ঠিক নোট তবে কার দোষ ? তা, লিখলি লেখ (নেশা চাপলে কী আর করা যাবে !) মূল লেখকের নামেই সব চালিয়ে দিচ্ছিস, নিজেদের নাম দেবার সাহস নেই ! মহান সব দার্শনিক আর পণ্ডিতদের নামে সব চালিয়ে দেওয়া কেন? এ কেমন চালিয়াতি বা জালিয়াতি ! কোনও নেশা না করেও আমাদের মত আজন্ম মুখ্যু মানুষদের মাথা গুলিয়ে বেসামাল অবস্থা। আবার সাহস কত বলে কিনা মানুষকে এসব বুঝতেই হবে। মামার বাড়ি আর কী, মেধার জোর ফলাচ্ছ ! পশট করে বল না বাবা আগে যা অনিবার্য ছিল তা বাতিল, যা হবে বলা হয়েছিল তা হবে না, নতুন করে লেখা হল। তা বলবে না। বললে আমরা যদি প্রশ্ন তুলি ! তা বাবা-বাছারা বুঝলে হে, আমরা ভাত মেখে খাই, ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। তোমাদের ওই মোটা মোটা বইয়ের বাণ্ডিল বাণ্ডিল বোঝা বারে বারে মাথায় নিতে পারব না। শা’...। কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল রে এঁদের ? নিকুচি করেচে, আমি চলি।
বললাম বটে ‘চলি’ কিন্তু আমাকেও তো নেশায় পায়। ভাবতে চাওয়ার নেশা, বুঝতে চাওয়ার নেশা। সমস্যা কুড়ে কুড়ে খায় ! ওটাতো একার না যে ‘Zআআ-ক্গে...” বলে গড়িয়ে যাব, পাশ ফিরে শোব ! মধ্যবিত্তের মাধ্যমিক সুবিধাবাদের স্তরে থাকি। পেপ্সি-পিজ্জা তো খাইনা, সঙ্গের অনেকেই খায়। বড় লোকের দল করলেতো খায়ই, গরিবের দল করলেও খায়। কোম্পানীর ছাপ মারা বোতলের জল না হলে ওঁদের পেট খারাপ হয়, ঠাণ্ডা গাড়িতে না চড়লে কাজ করতে পারেন না, শরীর খারাপ হয়। হবেই তো, কত থিয়োরী ঘাঁটেন, (অসহায়) জনগণের কত সমস্যার সুরাহা করেন। না পারলে পথ বাতলে দেন, তাতে খুড়োর কলও থাকে, আর থাকে “...বাপরে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে।“ গভীর তত্ত্ব-কথাও থাকে, “অর্থাৎ কিনা...গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কী ক’রে,/রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে”।
দেশটা যখন স্বাধীন হল নেতারা বলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ না কী যেন করবেন ! আবার পরে শুনলাম ঐ “ধাঁচের” সমাজ গড়তে হলে নাকি সমাজতন্ত্রীদেরই অর্থাৎ কমিউনিস্টদেরই নিস্ক্রিয় করতে হবে। তারও পরে দেখলাম ‘ধাঁচের’ পথ সুগম করার জন্য গণতন্ত্রকেই উচ্ছেদ করতে হবে। তা আবার অনেকের সহ্য হলনা, কার যে কী সহ্য হয় বোঝা মুস্কিল তো ! এত মহামতবিরোধ যে, কেউ একটা কিছু করতে গেলেই তা সে ভাল হোক আর মন্দই হোক বাকিরা চারদিক থেকে রে-রে করে তেড়ে আসে (হাতে লাঠিসোটাও থাকে)। আসলে চরম উত্তেজনা।এই নেশাটা না করলে রাতে তাঁদের ঘুম হয় না। জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধেও মানুষ উত্তেজিত হয়ে (হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও) প্রচণ্ড হই-চই করল। সে কী চিৎকার। চিৎকারের ভয়ে জরুরী অবস্থা উঠে গেল ! হ্যাঃ, ফের শুরু হয়ে গেল গণতন্ত্র। এতটাই গণতন্ত্র যে সবেতেই উদারতা। উদার অর্থনীতি, উদার শিল্পনীতি, কৃষি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য সবেতেই উদারনীতি। এদেশী কি বিদেশী কে নিবি আয়, যা নিবি নিয়ে যা, যতখুশি নে। আর যায় কোথায়, অমনি একদল বলতে শুরু করল এত উদার হওয়া চলবে না, চলবে না। উদারবাদীরা এসব হবে জানেন, তাই কানে তুলো গুঁজে উদারতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলেন। কিন্তু এ রোগ বড় ছোঁয়াচে রোগ। প্যাশনেট মানুষেরা তাঁদের কাজে নিজস্ব শৈলী বজায় রেখেও অনেক সময় পুরনো ফর্ম ভেঙ্গে নতুন ফর্ম সৃষ্টি করেন। এই সার্বিক উদারতার ফলে হল কি, যারা একেবারে কঠোর বা কট্টর ছিলেন তাঁরাও কেমন যেন উদার হয়ে গেলেন। কদিন আগে শুনছিলাম একটাও নাকি লাল ঝাণ্ডা থাকতে দেওয়া হবে না, আবার শুনছি তাঁরাই মে-দিবস পালন করছেন। লালঝাণ্ডা ছাড়া মে-দিবস হয় নাকি ? আবার শুনছি তাঁরা নাকি যারা মে-দিবসের লাল ঝাণ্ডা তুলতে গেছিল তাদের কাকে কাকে খুন করেছে। “ আকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে/দেখে চেয়ে কত লোকে সব কাজ ফেলে/ তাই দেখে খুঁৎ-ধরা বুড়ো কয় চটে/ দেখছ কি, এই রঙ পাকা নয় মোটে।“
সমাজতন্ত্রীরা আগে বলতেন---পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, ব্যক্তিপুঁজির উচ্ছেদ, বিদেশী ও একচেটিয়া পুঁজির জাতীয়করন, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব, শোষণ ও পুঁজি সৃষ্টিকারী বাজার অর্থনীতি বন্ধ এরকম আরো কী কী সব। এখন আবার তাঁরাই বলছেন বাজার থাকবে, ব্যক্তিপুঁজি থাকবে, একনায়কত্ব হবে না, বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকবে, বৃহৎ পুঁজির বিকাশ ঘটাতে হবে ইত্যাদি।“...খাপ পেতেছেন গোষ্ঠ মামা/... এইবার বাণ চিড়িয়া নামা---চট্/ওই যা ! গেল ফস্কে ফেঁসে--- হেই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে ?” আগে শুনতাম শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব আর উৎপাদন-বাজারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ। এখন শুনি---‘না না, ওটা ভুল। যারা ও পথে গেছে তাঁরা টিঁকতে পারেনি, যেমন সোভিয়েত রাশিয়া। তাই বহুদলীয় গণতন্ত্র চাই। সর্বহারার একনায়কত্ব নয়, চাই সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা’ (মানেটা কি ? বহুদলীয় ব্যবস্থায় টিঁকবে তো ?) এর পরে আর কিছু মনে রাখতে পারিনি, সব ভুলে মেরে দিয়েছি। সমাধান আদৌ আছে কিনা, থাকলে ঠিক কোন পথে, কোথায় তা বুঝতে পারিনা, এঁদের ‘ধাঁচ’ও বুঝতে পারিনা। তবে হ্যাঁ আমার মাথা একটু কম বলে গুলিয়ে ফেলা আমার সহজাত আর ভুলে মেরে দেওয়া আমার বেশি বয়সের প্যাশন মানে নেশা মানে...(কেউ বারণ করলেও শুনছি না)।
(২) আদর্শের নেশা। বলেছিলাম চলি কিন্তু ঐ যে বললাম না, হাজার বার চলি বলেও রেহাই নেই। স্কুলে পড়তে গেলে, কলেজে পড়তে গেলে, অফিসে চাকরি করতে ফেলে, পাড়ায় থাকতে ফেলে, বাড়ির বাইরে বেরোতে গেলে আদর্শের নেশাগ্রস্তদের পাল্লায় পড়তে হবে। এঁরা আদর্শের বানে সাঁতরে এসেছেন (আমরা ভেসে)। তাই এঁরা আদর্শবান এবং আদর্শবাণ। আবার এঁরা বাণবিদ্ধও বটে ! সব বাণ তাঁদের ‘ডেকাড্রন’-এর মত ‘রি-ভাইট’ করে। শিক্ষা তো দান করলে বাড়ে। আদর্শবানেরা মানে আদর্শে নেশাগ্রস্তেরা নিজেদের শিক্ষা, ভোট এবং সংগঠন বাড়াবার জন্য, মিছিল সমাবেশে গণবৃদ্ধি করে বিপক্ষকে শক্তি দেখাবার জন্য আদর্শের বাণ তুণে ভরে একজন একজন করে বহুজনকে বাণবিদ্ধ করবেন। তোমাকে পাকড়াও করে মর্মস্পর্শী স্বপ্ন দেখাবেন। তুমি ‘চাচা পা-লা’ বলে পালাতে পারলে বাঁচলে, নয় তো গেলে। “আয় তো দেখি, ব’সতো দেখি এখেনে” বলে ধীরে ধীরে তোমাকেও এঁরা নেশারু বানিয়ে ছাড়বেন ! আদর্শের জন্য এঁরা মা-বাবা-বউ-ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি-বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-স্বজন-ঘর-বাড়ি সব ছাড়তে প্রস্তুত। এত কিছু ছাড়লেও তাঁরা তাঁদের নেশা ছাড়বেন না। অন্য সব নেশারু এঁদের কাছে হার মানতে বাধ্য। মাথা ঝিম ঝিম করছে ? একটু তামাক খাবেন ?
(৩) তাত্ত্বিক হওয়ার নেশা। এ বড় মারাত্মক কঠিন নেশা। মারনাত্মকও বটে। অনেক কষ্ট করে আয়ত্ত্ব করতে হয়। এ নেশায় আসক্ত হওয়ার হাতছানি আছে কিন্তু সবাই হজম করতে পারেন না। এ নেশায় আক্রান্ত কারা ? রাজনীতির নেশাগ্রস্তদের সংগে একটু মেলামেশা করুন তবে তো বুঝতে পারবেন এঁরা কারা। যারা নিজেদের একটু নেতা-নেতা ভাবেন তাঁরা এটা করার চেষ্টা করেন। প্রথম প্রথম সকলেই একটু-আধটু বিষম খান, কাশি হয়, মাথা ঘোরে। কেউ কেউ পরে ধাতস্থ হয়ে ওঠেন, ঝানু নেশাড়ু হন। যারা হতে পারেন না, হয়তো কোনওদিন হতে পারবেন না তাঁরাও কিন্তু সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নন। তাঁরাও যে ‘তাত্ত্বিক’ সেটা তাঁরা প্রমাণ করেই ছাড়বেন। আর যারা ঝানু তাঁরা সুযোগ পেলেই “...এই মনে কর রোদ পড়েছে ঘাসেতে,/এই মনে কর, চাঁদের আলো পড়লো তারই পাশেতে---“ শুরু করে দেবেন। “বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সুক্ষ্ম হ’তে স্থুলেতে...” আমার মাথা কেমন যেন হচ্ছে।
(৪) বক্তৃতার নেশা। ওরে সর্বনাশ ! সে এক হাস্যকর নেশা। বক্তা হতে হবে, কারণ তিনি জন-সমক্ষে বিশেষভাবে পরিচিত হতে চান, দলে কদর পেতে হলে আর মানুষের আদর পেতে হলে বক্তৃতাই একমাত্র উপায়। নেতা অথচ তিনি বক্তৃ করতে পারেন না এটা কেমন ? তাই পারুন না পারুন, কেউ শুনুক না শুনুক কিংবা শুনে পেট চেপে হাসুক, বিরক্ত হোক... যা ইচ্ছে করুক তিনি বলবেনই এবং অনেক্ষণ বলবেন।
ভোট এলে ভাবি এত ভয়ংকর সব আগ্নেয়গিরির এত উৎপাত এত দিন চাপা পড়ে ছিল ! শাখা-প্রশাখা ছোট বড় সমস্ত শিখর থেকে সে কী অগ্ন্যুৎপাত ! একে অপরের দিকে ছাই ছুঁড়ে চাপা দিতে চাইছে, চাইছে যাতে দম নিতে না পারে। ‘করবই করব’ বলে কে কত বড় লিস্টি বানাতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে, ফলে চতুর্দিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন। বড় জনসভায় বলতে না পারলে উচ্চশিখরেরা বলেন ‘আমাকেতো তোমরা ডাকোই না’, পথসভায় ছোটরা বলে ‘দেখেছ, আমাকে বলতেই দিল না’, ঘরোয়া সভায় ক্ষুদ্র শিখরেরা বলতে না পেলে মন খারাপ করে। ফলে ঘরোয়া সভা গুলোতে স্রোতার চাইতে বক্তা বেশি। মাঠে ময়দানে তো মারাত্মক অবস্থা। একই মাঠে ডেকরেটর আজ এর ম্যারাপ বাঁধে তো কাল ওর ম্যারাপ বাঁধে। মাইকের সংখ্যা আগের দিনের চাইতে বেড়ে যায়। এসময়ে চলে রাজনীতির ষোল আনা নেশা করার উৎসব। বক্তাদের ফাইনাল পরীক্ষা হয়। আচ্ছা, দয়া করে একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ কি দেবেন ? ছাড়া-পাগল যদি নেশা করে তবে তার পাগলামো কতটা বাড়ে ? দেশসেবক (দেশ-সেবক)-রা কাজ পাগল হন। এবং তাঁরা বদ্ধ থাকেন বলে কখনো শুনিনি।
(৫) নেতা হওয়ার নেশা। এটা মানুষের জন্মগত প্রধান নেশা ক’টির মধ্যে অন্যতম। ইংরেজীতে যেমন ‘টপার হওয়া’ বলে। উঁচুতে ওঠো, সর্বোচ্চে ওঠো, বিজয় অর্জন কর, বাহবা পাও এবং যারা পারল না তাদের শাসন কর, পরিচালনা কর। এ নেশা না থাকলে মহা মহা দুর্যোগ পেরিয়ে সবাইকে টপকে এই প্রজাতি মানুষ হতে পারতো না। লাফিয়ে বন্য ঘোড়ার পিঠে উঠতে আর মাঝে মাঝে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙতে কে বলেছিল ? পেছনে ছুটে ঘোড়ার লাথি কি বেচারা কম খেয়েছে ! শরীরের সাথে রক্তের, রক্তের সাথে নেশার যে সম্পর্ক রাজনীতির সাথে নেতা হওয়ার সম্পর্ক ততটাই জড়িত, অচ্ছেদ্য।অনেকেই আছেন যাঁরা নেতা হওয়ার জন্যই রাজনীতি করেন। তাঁরা সোজাসাপ্টা বলেন, “প্রমোশন পাওয়ার জন্যই তো কাজ করা”। রাজনীতি করার পেছনে তাঁদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। বাকিদের তো রাজনীতিতে এসে ‘নেতা’ ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে। নেতা হওয়ার নেশা না থাকলেও অনেকে স্বভাবগুণে নেতা হন। তাঁদের একটা বড় অংশ তারপরেও সাধারণের মতোই থেকে যান, অল্প কয়েক জন নিজেদের ‘হনু’ ভাবেন। যাইহোক, স্বভাব নেতার ‘নেতৃত্ব নেশা’ অনায়াস ছন্দে রক্তে মিশে যায় আর প্রতিযোগী নেতার নেতৃত্ব-নেশা সচেতন ভাবে অভ্যাস করতে হয়। সে জন্যে কাজ করার সাথে সাথে তাঁদের আরও কোন কোন গুণাবলি আয়ত্ব করতে হয়। যেমন টুকুস করে অন্য প্রতযোগিদের পা চেপে দাও। সে এক মহা-সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা ! ল্যাঙ মার। পেছন থেকে, সামনে থেকে, পাশ থেকে, প্রকাশ্যে, লুকিয়ে-চুরিয়ে যে ভাবে পার ল্যাঙ মার (নিজের ঠ্যাং শক্ত না হলে অন্যকে দিয়ে)। কেন, তা না হলে নেতা হওয়া যায় না ?যায় রে বা যায় কিন্তু তার জন্য তো কাঠ খড় পোড়াতে হয়। জানতে হয়, সময় দিতে হয় দায়িত্ব নিতে হয়, কাজ করতে হয়, বুদ্ধি রাখতে হয়। ঠিক ঠিক যোগ্যতা না থাকলে নেতা হবি কেমনে ? ঠিক যায়গা মত তেল আর সন্দেহ আর টুকলি না চুকলি কী বলে সেসব আর সঙ্গে চক্রান্ত। অথবা যারা সত্যি নেতা, মানে এসব ছাড়াই নেতৃত্বে উঠে আসেন তাঁদের বিশেষত বড়দের ‘যথাযথ সম্মান’ দিতে শেখ। আড়ালে আবডালে আজেবাজে ঠাট্টা কথা যাই বলনা কেন জনসমক্ষে কখনো বোলো না বরং একটু খুশি রেখ (হেঁ হেঁ, আপনি হলেন গিয়ে সব, আর কে আছে !)। আর প্যাঁচ-পয়জারটা একটু ভাল করে বুঝে নিও, আয়ত্ব করে নিও। নেতাদের মধ্যে যারা ঠিক প্যাঁচ-পয়জার বোঝেন না তাঁরা হঠাৎ অবাক হয়ে খেয়াল করেন তাঁর জায়গাটা নড়বড় করছে। কাজেই শুধু নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকলেই হয় না। প্যাঁচ-পয়জার বুঝে নিজের জায়গাটা ঠিক রাখতে পারেন নি এটাই তাঁদের অযোগ্যতা।
(৬) সংগঠন গড়ার নেশা। এটা এক ধরণের কিডন্যাপিং-নেশা। স্কুল থেকে ছেলেগুলোকে ধরে কে যেন কোথায় নিয়ে গেল কেউ জানে না। ছেলেরা জানেনা, বাড়ির লোক জানে না, মাস্টার মশাইরা জানেন না কিন্তু গেল। কিডন্যাপিং ছাড়া কী ? তারপর ‘যন্তর-মন্তর ঘরে’ চালান করে দাও। ‘মগজ ধোলাই’ হবে। এরপর রইল কলেজ, পাড়া, কারখানা, অফিস, চাষবাস, সংগঠিত, অসংগঠিত কত কী। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে এদের নিয়ম শেখাও, শৃংখলা শেখাও,আনুগত্যের নামে বশ্যতা শেখাও। এক কথায় এদের দলীয় করে তোল। দলে না ঢুকলে “অভয় দিচ্ছি, শুনছো না যে ? ধরব নাকি ঠায়াং দুটা ?/ বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা !” (পাড়ায় থাকি। মারবে না তো, ধরবে নাতো কলার চেপে ?)।
হ্যাঁ এ ব্যাপারে একটা কথা সব্বার জানা উচিত। এই যে সবাইকে ডেকে-ডুকে আনতে হয় তার জন্য পয়সা খরচ হয় বইকি, হ্যাঁ হ্যাঁ পকেটেরই। অল্পসল্প এটা ওটা খাওয়াতে হয়, গাড়িভাড়া দিতে হয়। অভাবী ঘরে আরও কিছু সাহায্য দিতে হয়। মাঝে-মধ্যে সে জন্যে চাঁদাও তোলা হয়। এ তো ঐ কী বলে গিয়ে, রাজনীতির নেশা। আর এই নেশাটা যখন ওদেরও ধরে যায় তখন ওরাই আবার নিজের মত করে একই কাজ করতে থাকে। এস ওয়াজেদ আলি। নইলে জীবন সচল থাকে না, ইতিহাস তৈরী হয় না। তাই ভুল করেও এ নেশাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না, অবহেলা করবেন না। এ নেশা জীবনদায়ী এবং জীবন-দায়ি নেশা।
(৭) সকলের কাছে নিজেকে জাহির করার নেশা। এটা হল দলীয় মুখপাত্র হওয়ার ও বিবৃতি দেওয়ার নেশ। কে না চায় ? যারা চায় না তাঁরামুর্খ ‘দি ইনফিনিট’। আরে বাবা বিজ্ঞাপন ছাড়া বানিজ্য হয় না, তা সে যত ভাল ‘মাল’-ই হোক না কেন। আজকাল তো সোনায় সোহাগা ! বৈদ্যুতিন মাধ্যম তো প্রায় সব ঘরে, যেখানে বিদ্যুৎ সেখানেই বৈদ্যুতিন ! আনপড় মানুষও দেখে শোনে। কত সহজে, কত কম সময়ে লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে বৈঠকখানায় বসে পরিচিত হওয়া যায়। আঃ, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে ?বাড়ির লোক, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, দলীয় কর্মী, বিদলীয় কর্মী, নির্দলীয় কর্মী, নিষ্কর্মী, থানা, স্বেচ্ছাসেবি, পূজা কমিটি সকলের কাছে ‘ওজন’ বাড়ে। শেতলা পূজার সিন্নি খাওয়ার নেমন্তন্ন পর্যন্ত হয়। তবে কখনো কখনো বিপদে পড়তে হয়। বেফাঁস কথা একবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলেই হল, কৃষ্ণেরও সাধ্য নেই রক্ষা করবেন। তা ছাড়া কিছুদিন আগে কোনও এক দলে বলা নেই কওয়া নেই ছোট বড় যে যেখানে পারে বিবৃতি দিতে শুরু করল। অন্তর-কলহ বাতাসের বিশেষ উপাদানে ভর করে অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে পড়ল। অম্নি নেতা নেত্রীগণ’এসব হচ্ছেটা কী ?’ হুংকারে মা দুর্গার মত অনেক ওপরে বড় বড় তিনটে চোখ কটোমটো করে খড়্গ না ত্রিশুল না চক্র কোনটা ছুঁড়বেন ভেবে না পেয়ে শুধু ফোঁস করলেন। তাঁরা একবারো ভাবলেন না নিজের মুখটা চেহারাটা বার বার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে টেরিয়ে ভালভাবে দেখার ইচ্ছে কার না করে? এর জন্যি তো আগে ছিল জলদর্পণ তারপর কাচের আয়না তারপর হল ফটোগ্রাফি তারপর চলচ্ছবি। সাদাকালো রঙচঙ চলছে ফিরছে কথা বলছে----যেন জীবন্ত ! তাই যদি না হবে তো মঞ্চে এ্যাত্তো লোক ওঠে কেন ? এ ইচ্ছেটা তো নেশাই না কী ! নইলে পাড়ায় যে দাম, মানে জনপ্রিয়তা বাড়ে না, নিজেকে কেমন একা-বোকা মনে হয়। দিনের শেষে কেমন যেন একটা অবসাদ চেপে বসে, চারদিক কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, ভেঁউ-উঁ-উঁ করে কান্না পায়। পরদিন সকালে উঠে কাজ করার মত ‘ এনার্জি’ মানে উত্তেজনা হয় না। স্টিং অপারেশন না কি যেন একটা হচ্ছে আজকাল, সেটা না থাকলেই হল। একটু বুঝবেন না যে ওই হতচ্ছাড়া সাংবাদিকরা একের পর এক এমন সব প্রশ্ন ছুঁড়তে থাকে যেন শ্যাম্পেনের বোতল এগিয়ে দিচ্ছে, ওঃ। ফলে দু-এক সময় হয়তো স্লিপ করে যাই (পদস্খলন না), বেসামাল হই। কীর্তনীয়ার মত মাথা দুলিয়ে সুর করে ছন্দ মিলিয়ে ভুলভাল বলে ফেলি। তা’ এরকম অভিজ্ঞতা তো আপনাদেরও অহরহ হয়। আপনারা অভ্যস্ত বলে সামলে নিতে পারেন। আমাদেরও তো শেখা দরকার, অভ্যেস করা দরকার, না কি বলুন। আপনাদের সব কথাই তো আমরা শুনি (যখন বলে তখন, তারপর আর মনে রাখিনা)। এই নেশার ব্যাপারটাও কি তেমনই করব ম্যাডাম-স্যার ? রাসটিকেট করে দেবেন না তো ? দাদু বলেছিল আমার কপালে নাকি রাজটীকা আছে !
(৮) কূটনীতির মাধ্যমে শান্তি ও বন্ধুত্ব রক্ষার নেশা। এ নেশার মূলে থাকে ব্যবসা ও দেশের নিরাপত্তা। বড় দেশ যারা বিশ্বজোড়া ব্যবসা বাণিজ্য করে, যুদ্ধ করে, যুদ্ধ থামায়, অস্ত্র বেচে, সম্পদ দখল ও লুট করে তারা দেশ প্রধান কূটনীতিক দূত ছাড়াও প্রত্যেক বিষয়ের আলাদা আলাদা দূত রাখেন। তাঁদের সঙ্গে ঐ বিষয়ে একদল বিশেষজ্ঞ থাকেন। প্রধান রাষ্ট্রদূত দান-অনুদান উপঢৌকন নিয়ে বেশ হাসিহাসি মুখে ভৌগলিক, রাজনৈতিক, বৈষয়িক অবস্থান অনুযায়ী বিদেশে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের দেশের ব্যবসার ক্রেতা ঠিক করা। ক্ষুদ্রার্থে ‘সেলসমান’ ভালভাবে বললে ‘সেলস এক্সিকিউটিভ’। বেবিফুড থেকে সাবান, তেল থেক কামান, গাড়ি থেকে উড়োজাহাজ সব বিক্রী হয়। সবচাইতে মজা হল এসব কেনাকাটির জন্য ওরাই আবার টাকা দেয় ! ভাল ছেলের মত যাতে কথা শুনে চলে যারপরনাই সে চেষ্টা হয়। কৃত্রিম হলেও থাকে হাসি, রাগ, দান-খয়রাত, দর কষাকষি, প্রতিবেশী শত্রুদেশের প্রতি সাবধান-বাণী, কিছু প্রতিশ্রুতি এবং অবশেষে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন ও যৌথ বিবৃতি। এই প্রচেষ্টায় যদি কাজ না হয় তবে বিশেষ কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞ দল প্রেরণ। প্রশাসন আর ব্যবসাকে নিজের মতো করে সাজাবার জন্য অভ্যন্তরীণ চক্রান্তও এর অন্যতম অঙ্গ যাকে অন্তর্ঘাতও বলা যায়। এটা রাজনীতির গভীর ও জটিল নশা। আপনিও ঠিকমত আয়ত্ব করে পাড়ায় প্রয়োগ করতে পারলে খুব ভাল থাকবেন, ধরা না পড়লে তো কথাই নেই।
(৯) দেশ গড়ার নেশা। নন্দলাল তো অনেকদিন আগে স্বদেশের তরে নিজের প্রাণ রক্ষার প্রাণ-পণ প্রচেষ্টা নিয়েছিল। ওটা ব্যাঙ্গাত্মক দেখে মোটামুটি সবাই ঠিক করল, ঊল্টোটা করতে হবে। না হলে সুইস-ব্যাঙ্কে ব্যালান্স বাড়ে যার কোন হিসেব পাওয়া যায় না ! কত আয় হলে দারিদ্র সীমার এপার-ওপার করা যায় কিংবা কতটুকু আয়ে খাওয়া না খাওয়ার মাঝখানে থাকা যায় জানেন কি? আপনি কি ডলার দিয়ে কলমি শাক কেনেন ? কেন চেপে যাচ্ছেন ভাই, নিশ্চয়ি আপনি কেনেন ! আর সেজন্যে আপনাকে খরচ কমাতে হবে কারণ আপনার জন্য দেশ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমেছে, তাই টাকার দাম কমেছে, তাই আপনার দামও কমেছে, তাই জিনিসের দাম বাড়ছেই, তাই আপনি কম খরচ করবেনই, তাই.........। বিদেশে জিনিসের দাম বাড়লে আমাদের এখানেও বাড়ে কারণ আমাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। বিদেশে দাম কমলেও আমাদের দেশে বাড়ে কারণ তখন আমাদের টাকার দাম কম থাকে। আমি অঙ্কের ছাত্র ছিলাম না, আমার কাছে অঙ্কটা বুঝতে চাইবেন না। শুধু খেয়াল রাখবেন আপনার জন্য দেশকে ডলার দিয়ে যেন কিছু কিনতে না হয়। মনে রাখবেন আপনারা খাচ্ছেন বেশি, তাই মুদ্রাগুলো স্ফীত হচ্ছে। এসব বন্ধ করুন, আমাদের কথা শুনুন। দেশ গড়ার এবং রক্ষা করার দায়িত্ব যখন আমাদের, তখন “কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হবে। কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে সে সব। অসুখ হলে তেতো ওষুধ খেতে হয়”, ------ আসুন খাইয়ে দিই !
(১০) দেশ দখলের নেশা। এ নেশার আরেক নাম পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করা, গায়ে পড়ে ঝগড়া করা। দোষ নেই তবু আছে কারণ আমি বলছি আছে তাই আছে, সুতরাং শাসন করতে হবে, শিক্ষা দিতে হবে। বড় বড় দেশগুলো জোট বাঁধে আর নির্ভরশীল দেসগুলো পেছন পেছন যায়। জাহাজে করে, প্লেনে করে লাখে লাখে সর্বোন্নত অস্ত্রধারী সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষক বাহিনী অবাধ্য দেশের মাটিতে নেমে গেল, আকাশে উড়ে বেরাল। গুলি ছুঁড়ল, বোমা ফেলল, আগুন ধরাল, মানুষ মারল অবশেষে সে দেশটা নাকি ভাল হল। দেশটার বেশ ক্ষতি হল, মানুষগুলো মরল তাতে কী করা যাবে, শান্তি না ফেরা অবধি শিক্ষক সেনা সেখানে থাকবে। বিশ্ব-রাজনীতির শীর্ষকর্তারা যে কোনও প্রান্তের যে কোনও দেশের গণতন্ত্র-শান্তি-সমৃদ্ধির দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে রেখেছেন। মন্দ লোকে একে ইজারা নেওয়া বলে কিন্তু এ নেশা ছাড়া তাঁদের দিনগুলো পান্সে লাগে, নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ এ নেশাকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেয় না ঠিকই কিন্তু বাধা দেওয়ার জন্যও সক্রিয় হয় না। তাই তাকে পাত্তা দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না। উপরন্তু যে কোনও ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জ তো বিশযুদ্ধবাজদের ওপরই নির্ভরশীল। আগে তো সকলের নেশাটা হোক।
(১১) মধ্যস্থতা করার নেশা। চিরকালীন বহুল প্রচলিত নেশা। ভেতরে বাইরে যখনই কোনও রকমের বিরোধ বা যুদ্ধ শুরু হয়, কিছুতেই মীমাংসা হতে চায় না, তখন একদল মানুষ আছে যারা উভয় পক্ষের হয়ে মিটমাট করতে আসেন। কার কিসের ঝগড়া কে মেটায় ! শত্রুর শত্রু আমার মিত্র---এটা তো বরাবরই আছে। তখন মধ্যস্থতাকারীর দরকার হয় না। দু পক্ষই “... মিথ্যে কেন লড়তে যাবি ?ভেরি-ভেরি সরি, মশলা খাবি ?” আর কাজ ফুরোলে কী হয় আমরা তো তা জানি ! এ্যায় ! পায়জামো বন্ধ কর, আত্মপক্ষ সমর্থন না, আত্মসমর্পণ কর--- নইলে---! নইলে কী--- হে ঈশ্বরসম ? নইলে “আমি আছি। গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে---“। তারপর তো চলল এনকাউন্টার, আহতের পলায়ন, আত্মসমর্পণ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।তাই মধ্যস্থতা “শেক্হ্যাণ্ড আর ‘দাদা’ বল, সব শোধ বোধ ঘরে চল্”। তা’ এ অবস্থায় যদিও সাফল্য অনিশ্চিত তবু মধ্যস্থতাকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন এটাই তো স্বাভাবিক। কী করবেন তাঁরা ? তাঁরা বলেন, “ছায়া ধরার ব্যবসা করি তাও জাননা বুঝি ?...”। আচ্ছা বলুন তো, সব পক্ষ থাকবে আর ওঁরা থাকবেন না তাও কি হয় ? ওঁদের কি নেশা করার কোন অধিকার নেই ? মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ। আইনসভায় তাঁদের মনোনীত করা উচিৎ। সেখানে তাঁরা সরকার পক্ষ বিরোধী পক্ষ ঝগড়াটে পক্ষ মারকুটে-ভাঙচুরে পক্ষ সবার মধ্যে দাঁড়িয়ে মধ্যস্থতা করবেন। এ নেশাও তো দরকার । তা হলে লোকসভা চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারে বেশ বৈচিত্র আসে, একটু রিলিফ পাই ! রিলিফ না থাকলে আর্ট হয় না, নেশা তো একটা আর্টই ! এ প্রস্তাবটা মন্দ নয়। অধমের অনুরোধ কি রাজনীতির পাঁড় নেশাড়ুরা রাখবেন !
(১২) দল বদলের নেশা, নতুন দল গঠনের নেশা। বোধহয় সর্বশেষ নেশা, নেশা জমে যাওয়ার নেশা। গত পড়শু অবধি গাঢ় নেশারু বাবুকে যে দলের নেতা বলে জানি, কাল থেকে শুনছি---উনি যাবেন যাবেন যাবেন...এই গেলেন বলে। আজ রাতে শুনলাম উনি চলে গেছেন অন্য দলে নয়তো তিন জনের একটা নতুন দল গড়লেন ( সেক্রেটারি, প্রেসিদেন্ট, ট্রেজারার)। কারণ আগের দলের ছিলিমটা পুরনো হয় গেছে ! তাই যদি না হবে তবে এ দলেও রাজনীতি সে দলেও রাজনীতি, দল বদলের দরকারটাই বা কি আর নিষেধাজ্ঞাই বা কেন ! অথচ এসব নিয়ে আইনসভা তো বেড়ে চোখ লাল করে বসে আছে ! দলত্যাগ-বিরোধী আইন। ওঃ, নেহাত ‘সংসদে’ ছাপার ভুলের ভুত চাপে না তাই রক্ষে, নয়তো সবার পেট ফুলে...নাক চেপে...দুঁর্গন্ধঁওঁওঁ......! আসলে সবই দল করার নেশায় পাওয়া মানুষদের ইচ্ছে বা আপত্তির ফল ! আইনসভাগুলোতে সবাই নির্দল হলে ক্ষতিটা কী ? ধরাবাঁধা নেশাটা ছুটে যাবে তাই ?
রীতিমত ভয় করছে, যদিও “ভোলে বাবা পার করেগা” তবু আর এগোনো উচিত হবে না। এই কেতাবে “সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনাকো লেখা কোথায়-- / পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন ক’রে ঠেকাব তায় !”
দেশী গরুটা যে কার ? শা’--- ।
......
আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।