প্রাথমিক কথা

প্রাথমিক কথা

FOR YOUR COMMENTS

Click "[_] commetns:" at bottom of Post

Tuesday, September 30, 2014

এতদিন পর্যন্ত যাদবপুর-বিষয়ক চর্তমান আন্দোলনের যে চেহারা ও শক্তি ছিল তা এবার থেকে কমতে শুরু করবে বলেই আমার আশংকা হচ্ছে, তাতে অত্যাচারি ও শাসকেরই জয় হবে।

"আগের সরকারের" ইতিহাসতো অনেক বড়, অনেক দীর্ঘ, মাত্র শেষ এক দশকের বা দু দশকের না। এমনকি মাত্র চৌত্রিশ বছরেরও না। সে ইতিহাস শেষ এক বা দু দশকের বিস্ময়কর বিচ্যুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। বরং তার আগের সরকারের এহেন জনবিরোধী ভূমিকার ইতিহাস অনেক বেশি দীর্ঘ, অনেক বেশি নৃশংস, অনেক বেশি পৈশাচিক, অগ্ণতান্ত্রিক, অনেক বেশি স্বৈরতান্ত্রিক। সেই দীর্ঘ সময়ের ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক কারা ছিলেন ? বর্তমানের যাদবপুর/প্রেসিডেন্সির ক্রমশ ক্ষীণ হতে চাওয়ার ভুল পথে যাওয়া নেতৃত্ব সে ইতিহাস একটু ঘেঁটে দেখলে ভাল করবেন। সে সময়ে কিন্তু সার্বিক ঐক্য গড়ে তুলেই স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন , ছাত্রের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে আন্দোলন করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও চাই সবরকম দাম্ভিকতা, অগণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র জনবিরোধী আচরনের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ, কিন্তু এই খসড়া প্রস্তাবে মনে হচ্ছে সে বৃহত্তর ঐক্য ভেঙে যাবে।

"মাওবাদী" প্রসঙ্গ ...... আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যে মাওবাদীরা ছিল এবং আছে এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। মাওবাদীদের কথা "নন্দীগ্রামের আন্দোলন" থেকে শুরু নয়। তারও আগে থেকেই তথাকথিত মাওবাদীদের দ্বারা সাধারণ মানুষ ও বাম আন্দোলনের কর্মী-নেতা-শিক্ষক তাঁরা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে না নামলেও তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। সম্মুখ সমরে কিংবা গেরিলা লড়াইতেও প্রধাণ শত্রু শিবিরের সৈনিক ও সেনা নেতৃত্বকে হত্যা করা হয়ে থাকে। তার অন্যথা একমাত্র আমাদের দেশেই ঘটতে দেখসছি।

বর্তমান শাসকেওদের এই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতায় এনে দেওয়ার এক বিরাট শক্তি হিসেবে সমাজের নানা অংশ, নানা রাজনৈতিক দল কাজ করেছে। তাঁদের মধ্যে সশস্ত্র মাওবাদীরা যে ছিলেন এটা মাওবাদীরাও অস্বীকার করেন না। তাঁরাই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রিকে যোগ্য মুখ্যমন্ত্রি মনে করেছিলেন। এই মুখ্যমন্ত্রি সে সময়ে মাওবাদীদের অস্তিত্ব অস্বিকার করেছিলেন আর ক্ষমতায় আসার পর সেই মাওবাদীদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষনা করলেন। এও ইতিহাস।

আমার এবং আমার মত অনেকেরই একদিকে যেমন যাদবপুরের এই আন্দোলনে সমর্থন রয়েছে, এবং সেটা শুধুমাত্র বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে হচ্ছে বলে নয়, বরং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে হচ্ছে বলে। আমি সশরীরে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও আমার মত অনেক মানুষ এমনকি আগের সরকারের হাজার হাজার সমর্থক এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, বৃষ্টিতে ভিজে আপনাদের মতই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিছিলে হেঁটেছেন। তাঁদেরকেও এই আন্দোলনে রাখা প্রয়োজন, রাখতে চেষ্টা করতে হবে। তেমনই ওদেরও চেষ্টা করতে হবে একসাথে থাকার। আজ এবং আগামীদিনে গণতান্ত্রিক মানুষের, শোষন-অত্যাচার থেকে মুক্তির আন্দোলনে চিরকালই এই বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন।

আজকের যুগের বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতির আলোকে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা হল, মানুষের মুক্তির আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন কোনোদিনই শেশ হয়না, চলতেই থাকে। যখনই কোনো শক্তি তা সে কোনো এক যুগে যতই প্রগতিশীল হোক তারা ক্ষমতায় এলে নিজেদেরকে ক্রমশ একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। আর সর্বনাশটা এখানেই লুকিয়ে থাকেতাই মুক্তির আন্দোলন চিরকালীন। অত্যাচারিতের বৃহত্তর ঐক্য চিরকালই প্রয়োজন, বেশি বেশি করে প্রয়োজন। একথাটা সবাইকেই বুঝতে হবে। জেদ বা গোঁ এবং সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলতে হবে।

আগের সরকার ও ত্তার নেতৃত্ব শেষদিকে নিজেদেরকেই একটা সর্বশক্তিমান নির্ভুল প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন। সেই প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে গিয়ে যাদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপন করা হ'ল সেটা যে কত বড় ভুল তা নিজেদের বুঝতে হবে, মানুষকে বোঝাতে হবে। এ ভুলটা কাম্য ছিলনা।


তাই আমার ও আমার মত মানুষদের আবেদন যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ে, প্রতিটি জনবিরোধী ঘটনায় মিত্র শক্তির বৃহত্তর ঐক্য বজায় রেখেই আন্দোলন করতে হবে।

আমরা বরাবরই দেখেছি, আমাদের দেশে বিশেষত আমাদের রাজ্যে বামশক্তি ক্ষমতায় থাকলেই অতিবামেরা তাঁদের আন্দোলন তীব্র করেন এবং প্রধাণত বামেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ নামিয়ে আনেন ও এই প্রয়োজনে ডানপন্থী শাসকদের সাথে মৈত্রি স্থাপন করেন। এর ফল শুধু মাত্র বামপন্থীদের ক্ষতি করেছে তাই নয়, বামপন্থীরা দূর্বল হয়ার পর সেই দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী শাসকেরা অতি বামদের আরও নৃশংসভাবে শেষ করতে উদ্যত হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এবং সর্বশেষ বরানগর-কাশীপুরের ঘটনা তাঁদের মনে আছেতো ! এত শেখার পরেও তাঁরা পথ পরিবর্তন করবেন না ?
আবার বিপরীতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথেই সমাধানের আশায় এবং বিশ্বাসে বামপন্থীরা মাঝে মাঝেই দক্ষিণপন্থী এমনকি অতি দক্ষিণপন্থীদের সাথেও মৈত্রী গড়েছে। ন্যূনতম কর্মসূচীর কথা বলে তাঁরা দক্ষিণপন্থীর নেতৃত্বাধীন সমন্বয় কমিটিতে যোগ দিয়েছেন। সেই কমিটির পরিচালক ও নীতি নির্ধারক ছিলেন দক্ষিণপন্থীরা।এ ঘটনা আমরা যেমন ৭০-এর দশকে দেখেছি তেমনই দেখেছি কেন্দ্রে যুক্ত মোর্চার সরকারে এবং সর্বশেষ দেখেছি দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময়ে। চূড়ান্ত সময়ে দেখা গেহে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তাদের চরম স্বার্থ রক্ষার সময়ে নিজেদের ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নিয়েও বামেদের ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে। এসবের পরেও বামেরা তাদের সাথে যাবেন ?
অনেকের সাথে আমি সহমত যে, বামপন্থী আন্দোলনের এই সমস্ত শাখা প্রশাখা যদি মাঝে মাঝেই জনস্বার্থের কথা তুলে এবং ন্যূনতম গণমুখী কর্মসূচীর কথার আড়ালে দক্ষিণপন্থী শক্তির সাথে মৈত্রী গড়তে পারে তবে তাঁরা সে পথ ত্যাগ করে বৃহত্তর বাম ঐক্য কেন গড়তে পারবেন না?


প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, প্রথম যুক্তফ্রণ্ট আমলে বর্ধমানে সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড নিয়ে শোষক শ্রেণীর প্রচারকদের সাথে এক হয়ে আমাদের এখানকার অতিবামপন্থীরা (যাঁরা নাকি শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাস করেন) তাঁরাও সে সময়ের কৃষক আন্দোলনের বাম নেতৃত্বের বিরোধিতা করেন। অথচ তাঁরাই আবার জোতদার-জমিদারদের হত্যা করেছেন, শ্রেণীশত্রু তকমা লাগিয়ে গ্রাম-শহরে শ্রেণীমিত্রদের হত্যা করেছেন। এ অদ্ভূত বৈপরিত্য যখন দেখি তখন এটাই বিশ্বাস করতে মন চায় যে শোসক শ্রেণী ও অতিবামপন্থীরা আসলে পরস্পরের মিত্র। আমাদের সময়তেই কার্যত এ ঐক্য আমরা দেখেছি। যাঁরা শ্রেণীর অস্তিত্ব ও শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাস করেন তাঁরা তো জানেন পুঁজিবাদ, জোতদার-জমিদার বা শোসক শ্রেণী শ্রেণীসংগ্রাম ব্যাতিরেকেই কত নৃশংস হয়। এও জানেন যে কোনো যুদ্ধে দুপক্ষেরই যোদ্ধার মৃত্যু অনিবার্য। রুশ বিপ্লব, চীন বিপলব, কিউবা, কোরিয়া, ভিয়েতনাম কোথো এর অন্যথা হয়নি। শ্রেণী সংগ্রামের যে কোনো স্তরেই এটা হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের একটা পর্যায়ে সাঁইবাড়ির ঘটনাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করবেন। যদিও ৯০ থেকে ১০০ জনের মৃত্যুর ঘটনা সত্য বলে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার তারাও একথা বলেনি।

দ্বীতীয়ত বরানগর-কাশীপুর হত্যাকাণ্ড প্রসং। ঘটনা চক্রে আমি তখন সি পি আই (এম) এর সদস্য। বাড়ি ছাড়া, এখানে ওখানে থাকি। বরানগর-কাশীপুর অঞ্চলেও সি পি আই (এম) অনেক আগে থেকেই এলাকা ছাড়া হয়েছিল। ঐ অঞ্চলের বহু সদস্য জেলে ছিল। এমতাবস্থায় চি পি আই এম-এর নেতৃত্বে বরানগর-কাশীপুরের গণহত্যা চালানোর কথা হাস্যকর এবং অবাস্তব। বরং আমরা এ ঘটনায় আতংকিত ও চিন্তিত ছিলাম। তখন আমাদের প্রকাশ্যে আন্দোলন করা সম্ভব ছিলনা। কিন্তু আমাদের মধ্যে এটা আলোচনা হয়েছিল। ১৯৭৭-এর পর এই হত্যা বিরোধী কমিটির নেতৃত্বে যতগুলি কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে প্রতিটিতে সি পি সি এম অংশগ্রহণ করেছে। নকশাল পার্টির নেতৃত্ব এসব কথা ভালভাবেই জানেন। বন্দীমুক্তির সিদ্ধান্তের ফলে শুধুমাত্র সি পি আই এম বদীরাই মুক্তি পেয়েছে তা নয়, নকশাল পার্টির বহু নেতা ও কর্মীও মুক্তি পেয়েছেন। আপনার মত মানুষ পুঁজিবাদী প্রচারে বিশ্বাস করবেন এটা ভাবতে কষ্ট হয়।

তৃতীয়ত ঃ- বর্তমান সময়ে এসব কথা আমি উত্থাপন করতে চাইনি। আমার এসব কথা উত্থাপন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে কোনোদিনই ছিলনা। কিন্তু বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখে পথ খুঁজছি নিজে সান্তনা পাওয়ার জন্য। আমি বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। মতাদর্শগত পথ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কদিন আগের আমার লেখাপত্তর/মন্তব্য দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। আজকালের মধ্যে আমার আশংকা সত্য করে যে কথাগুলো নানা জায়গায় উঠে এল তাতে আমি আশংকিত যে বর্তমান সময়ে যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে অতীতের মতই ভুল ধারণা এবং সিদ্ধান্তর কারনে। শ্রেণী সংগ্রাম বলতে আমি কখনই মনে করিনা যে, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিবিরোধী একাধিক সংগঠন তারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিক্রিয়ার সংগে হাত মিলিয়ে মিত্রশক্তিকে আঘাত করবে। আমি একথাও  বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, মিত্রশক্তিকে কোনঠাসা করার জন্য শ্রেণীসংগ্রামের কোনো হত্যাকাণ্ডকে তুলে আনা উচিত।

আমি সমস্ত বিষয়টা নানা দিক থেকে বিচার করে সত্য-মিথ্যা ঠিক-ভুল শত্রু-মিত্র বুঝে নিতে চেষ্টা করি। আমি গত ছাব্বিশ বছর যাবত কোনো দলীয় রাজনীতির সংগে যুক্ত নই, কোনো দলীয় রাজনীতিক কর্মসূচীকেই সমর্থন করিনা। এসব নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে, বিতর্ক আছে। আমি চাই একটা বৃহত্তর ঐক্য সবাই গড়ে তুলুক, যদিও জানি আমরা কয়েকজন মানুষ চাইলেই তা হবে না। তবু চাইতে দোষ কি, তাই এত কথা বললাম।

Tuesday, June 24, 2014



আমরা কোথায় যাব ? --৪

আগের অনুচ্ছেদে যেখানে আমরা কথা শেষ করেছি সেখান থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আমাদের লক্ষ্য ও পথ নির্ণয়ের প্রয়োজনে আমরা অবিচ্ছেদ্যরূপে সুস্পষ্ট দুটি প্রেক্ষিত পাই। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত ও দেশীয় প্রেক্ষিত। আমাদের সময়তে বিশ্বব্যবস্থা সব দেশ-মহাদেশ-উপমহাদেশে এই দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক ও নির্ভরতা রেখেই শুধু টিঁকে আছে তাই নয়, এগিয়েও চলেছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে এখন আমরা যা দেখছি ও ভবিষ্যত সম্পর্কে মার্ক্সীয় দর্শনে যে অনিবার্য সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, সেই সমগ্র পর্যায়কে চরিত্র অনুসারে আমরা প্রধাণত দুই বিপরীতমুখী পরিচিতিতে ভাগ করতে পারি এবং এই দুই পরিচিতির প্রতিটিকে আমরা দুই প্রধাণ পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।

প্রথম যে দুই বিপরীতমুখী পরিচিতি, তার একটি হল, রাষ্ট্রীয় মালিকানা বহির্ভূত বা সর্বজনীন সামাজিক মালিকানা বহির্ভূত অসরকারি উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যাকে মার্ক্স চিহ্ণিত করেছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থারূপে। সেখানে উৎপাদন, বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ, বণ্টন সহ সমগ্র ব্যবস্থায় ব্যক্তিপুঁজিই মূল নিয়ন্ত্রক। আধুনিক যুগে বড় বড় শিল্পে একজন ব্যক্তির পুঁজির পরিবর্তে কয়েকজন পুঁজিপতির ও শেয়ার হোল্ডারের সম্মিলিত একটি কর্পোরেট সংস্থা সেসবের মালিক। উৎপাদন, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, বণ্টন বা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অধিক পুঁজির মালিকদের পছন্দ অনুযায়ী গঠিত একটি ম্যানেজিং বোর্ড। আমাদের দেশে কয়েক দশক আগে রাষ্ট্রীয় উদ্যগ, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, কয়েকটি শিল্প অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেসব ক্ষেত্রে পুনরায় অংশিদারী বিক্রী করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। কোন কোন উদ্যোগে সরকারী অংশিদারী কমিয়ে অসরকারি অংশিদারীর অনুপাত বাড়ানো হয়েছে। এমনকি বীমা, ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জ্বালানি উৎপাদন, পথঘাট ইত্যাদি পরিকাঠামো নির্মাণ, কৃষি-পণ্য উৎপাদন ও বিক্রী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে শুধু দেশীয় ব্যক্তি পুঁজি নয় বিদেশি লগ্নী পুঁজি ও বিদেশী ব্যক্তি পুঁজির প্রবেশের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। সরকারি অংশিদারিত্বের চাইতে বেশি হচ্ছে অসরকারী অংশিদারিত্ব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০% বিদেশী লগ্নি অনুমোদন করা হয়েছে।

এ ব্যবস্থায় কখনো কখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে রাষ্ট্র ততটুকুই নিয়ন্ত্রণ করে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ পুঁজির স্বার্থে প্রয়োজন। ব্যক্তপুঁজি যখনই সংকটে পড়ে রাষ্ট্র তাকে বাঁচিয়ে তলতে এগিয়ে আসে, আবার যখনই তারা সংকট কাটিয়ে ওঠে তখনই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়। একে দুটি ভাগে ভাগ করলে আমরা পাই একটি চরম অবস্থা যা ফ্যাসিজম নামে পরিচিত। ফ্যাসিজমের নমনীয় রূপ হল সাম্রাজ্যবাদ ও তার আগ্রাসী নীতি। দ্বিতীয় পাই পুঁজিবাদি ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলোর গণতন্ত্র যা পুঁজিবাদের নমনীয় রূপ। এই গণতন্ত্র যতক্ষণ পুঁজির স্বার্থে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় ততক্ষণই টিঁকে থাকে। মানুষ এই গণতন্ত্রকে ব্যবহার ক’রে পুঁজিবাদের কাছ থেকে, আপাতভাবে সরকারের কাছ থেকে নিজের স্বার্থ পূরণ করতে চায়। পুঁজির সংকট ও পুঁজিবাদীর অনীহার কারণে এই স্বার্থ পূরনের প্রচেষ্টা যখন পুঁজির মালিক বনাম পুঁজিহীন মানুষের সংঘাতের রূপ নেয়, সংঘাত চরমে পৌঁছয় তখন পুঁজির মালিক ও সরকার তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন বলে মনে করে এবং তখন তারা এই গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে, স্বৈরতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করে। এ অবস্থায় পুঁজিবাদ কখনো কখনো হিংস্র ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে, যে হিংস্রতা ও আগ্রাসী মনোভাব ফ্যাসিজমের প্রাণ।

উপরিল্লিখিত ব্যবস্থার বিকল্প বা দ্বিতীয়টি হল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উৎপাদন নীতি ও অর্থনীতি যার লক্ষ্য এমন এক ব্যবস্থার অভিমুখে যেখানে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, তা থেকে উৎপাদিত উপকরণ, বণ্টণ ও বাজার সহ সামগ্রিক অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে সর্বজনীন সামাজিক সমিতির মালিকানাধীন--- যেখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই লোপ পায়। এক কথায় শ্রেণীহীন, শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বরূপী রাষ্ট্রহীন সমাজ ব্যবস্থা, সাম্যবাদী সমাজ বা সাম্যবাদী অর্থনীতি। মার্ক্স–এর ব্যাখ্যায় যা আদিম যুগের যূথবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের আধুনিক রূপ বা বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী সমাজ। মার্ক্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই সাম্যবাদী সমাজের দুটি স্তর। একটি নিম্নতর স্তর ও অপরটি উচ্চতর স্তর।  সে ব্যাখ্যা অনুযায়ী নিম্নতর স্তরে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটবে না। যেহেতু এখানে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটেনা সেহেতু এখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে এবং সে রাষ্ট্র হবে সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের রাষ্ট্র। সেখানে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটানোর প্রক্রিয়া চলবে, যে প্রক্রিয়ার ফলে পুঁজিপতি শ্রেণীর বা পুঁজির ব্যক্তিমালিকানার অবলুপ্তি ঘটবে, ফলে সর্বহারা শ্রেণীরও অবলুপ্তি ঘটবে এবং সমাজ উচ্চতর সাম্যবাদী সমাজে উন্নীত হবে। সেখানে যেহেতু শ্রেণীর কোন অস্তিত্ব থাকবে না, সেহেতু রাষ্ট্রেরও কোন অস্তিত্ব থাকবে না। সমাজ পরিচালিত হবে একটি সমিতির দ্বারা।

এ প্রসংগে ইস্তেহারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মার্ক্স লিখছেন... ... “আগে আমরা দেখেছি যে, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের প্রথম ধাপ হ’ল প্রলেতারিয়েতকে শাসকশ্রেণীর অবস্থানে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করা।

(এই প্রথম পর্যায়ে) বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমে ক্রমে সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসকশ্রেণীরূপে সংগঠিত প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য এবং উৎপাদন-শক্তির মোট পরিমাণকে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রলেতারিয়ে তার রাজনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করবে। ( এই বিষয়টি অন্ত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ )

শুরুতে অবশ্যই সম্পত্তির অধিকার এবং বুর্জোয়া উতপাদন-অবস্থার ঊপর স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপ ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন হতে পারেনা ; সুতরাং তা করতে হবে এমন সব ব্যবস্থা মারফত, যা অর্থনীতির দিক থেকে অপর্যাপ্ত ও অযৌক্তিক মনে হবে, কিন্তু আন্দোলনের পথে এরা নিজ সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পুরানো সমাজ-ব্যবস্থার উপর আরও আক্রমণ প্রয়োজনয় করে তুলবে। উৎপাদন- পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপ্লবীকরণের উপায় হিসবে যা অপরিহার্য”। মার্কস-এঙ্গেলসের ব্যাখ্যায় এটা হ’ল সাম্যবাদের নিম্নতর স্তর।

মার্ক্স ঐ অধ্যায়েই এর পরিণতি ব্যাখ্যায় লিখেছেন.. ... “ বিকাশের গতিপথে যখন শ্রেণী-পার্থক্য অদৃশ্য হয়ে যাবে, সমস্ত উৎপাদন যখন গোটা জাতির এক বিশাল সমিতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে তখন সরকারী শক্তির রাজনৈতিক চরিত্র আর থাকবে না। সঠিক অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা হ’ল এক শ্রেণীর উপর অত্যাচার চালাবার জন্য অপর শ্রেণীর সংগঠিত শক্তি মাত্র। বুর্জোয়াশ্রেণীর সংগে লড়াই-এর ভিতর অবস্থার চাপে প্রলেতারিয়েত নিজেকে শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত করতে বাধ্যা হয়, বিপ্লবের মাধ্যমে তারা যদি নিজেদের শাসকশ্রেণীতে পরিণত করে ও শাসকশ্রেণী হিসাবে উৎপাদনের পুরাতন ব্যবস্থাকে তারা যদি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে, তাহলে সেই পুরানো অবস্থার সংগে সংগে শ্রেণীবিরোধ তথা সবরকম শ্রেণীর অস্তিত্বটাই দূর করে বসবে এবং তাতে করে শ্রেণী হিসাবে স্বীয় আধিপত্যেরও অবসান ঘটবে।

শ্রেণী ও শ্রেণী-বিরোধ-সম্বলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এক সমিতি, যার মধ্যে প্রত্যেকের স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত”। ( মার্ক্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটাই হ’ল সাম্যবাদের উচ্চতর স্তর। )


[ চলবে ]

Tuesday, June 10, 2014


আমরা কোথায় যাব ? --৩

মতাদর্শের প্রশ্নে আমাদের এখানকার পার্টিগুলোর অবস্থান জন্মলগ্ন থেকেই বড় অদ্ভূত !

প্রায়সই একটা কথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনীতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন এমন মানুষের কাছ থেকে শোনা যায় যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, আন্দোলন ও বিপ্লব ভারতীয় বৈশিষ্টের মধ্যেই থাকতে হবে। বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষিতে বা কোনো দেশের অনুকরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে হবে না। এ জাতিয় কথায় যথেষ্ট সারবত্তা থাকলেও এ প্রশ্ন উত্থাপন করা অত্যন্ত সংগত যে, আন্তর্জাতিক বিপ্লবী ঘটনাবলি ও বিশ্বদর্শন বাদ দিয়ে কি সাম্যবাদী বিপ্লবের ভাবনা, পরিকল্পনা, প্রয়োগ সম্ভব ? আমাদের তো ঠিক করতে হবে, আমরা কি শ্রমিক কৃষক ও সমাজের অন্যান্য অংশের সমস্যা-জর্জরিত মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার আশু ও আংশিক সমাধান দাবীর আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছি ? অথবা আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি এই সমস্যা সমুহের চূড়ান্ত সমাধানের আশায়, যে ব্যবস্থা এর মূলে রয়েছে তাকেই উৎপাটিত করে নতুন এক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বকালেই অগ্রসর হব ? নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় কোনো মানুষই প্রথম পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইবেন না। যাঁরা প্রথম পর্যায়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান তাঁরা অন্য কোনো দর্শনের কথা চিন্তা করার চাপ নিতে চাইবেন না। কারণ, হয় তাঁরা প্রকৃত অর্থে বোঝেনই না যে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে তাঁদের সমস্যার বীজ অথবা বুঝেও এই ব্যবস্থার সাথে আপস করে চলতে চান। তাঁরা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই কিছুদিন এক অংশকে ক্ষমতায় বসানোর পর আবার আরেক অংশকে ক্ষমতাসীন করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা তৃতীয় কোন শক্তির সন্ধান করে। সে জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেন। দীর্ঘ অপেক্ষায় তাঁরা এতটাই ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন যে, প্রথমে তাঁরা আঞ্চলিকভাবে ছোট ছোট সংগঠন গড়ে তোলেন এবং কিছুদিন পরে বর্তমান শক্তিগুলির মধ্য থেকেই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে অপর একটি নতুন জোট গড়ে ওঠে এবং মানুষের আস্থা অর্জন করে। ক্রমাগত এই অবস্থার আবর্তন-প্রত্যাবর্তন চলতেই থাকে। আমাদের দেশে ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে এই অস্থিরতা বেশি বেশি করে দেখা যাচ্ছে। জনগণ তো বটেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৃহদংশের চেতনাও এর চাইতে উন্নীত হতে পারেনি। এর প্রমাণ আমরা পাই প্রায় সব রাজ্যেই কখনও স্থানীয় দাবীকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের পর, আবার কখনও অন্য রাজনৈতিক দলের বিরোধীতা করেই এক বা একাধিক আঞ্চলিক দল গড়ে ওঠার মধ্যে। পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় স্তরে এই আঞ্চলিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ক’রে ক্ষমতা ভাগাভাগি ক’রে একটি সর্বভারতীয় জোটে সম্মিলিত হন। কিন্তু তাঁরা কখনই এই ব্যবস্থাটাকে ভাঙ্গতে চাননা, বরং নানাবিধ স্বার্থের সঙ্ঘাতে তাঁদের নিজেদেরই সেই জোট ভেঙে যায়। এদিক ওদিক সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও মূলত সাধারণ মানুষের দুর্দশা চলতেই থাকে।

সামজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চিন্তার ধারে কাছেও ঘেঁষেন না, শুধুমাত্র আধ্যাত্মবাদী মত ও পথেই থাকেন এমন মানুষের সংখ্যা এতই কম যে তাঁদের দর্শন নিয়ে আলোচনা এখানে অপ্রাসংগিক। তবু নিজ নিজ ধর্মে গভীর বিশ্বাস রাখেন আবার সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করেন এমন মানুষের সংখ্যা যেহেতু সর্বাধিক তাঁদের প্রসংগেও আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। নির্দ্বিধায় বলা যায় তাঁরা এক অদ্ভূত দ্বৈত মানসিকতার মানুষ। তাঁরাও উপরে আলোচিত আবর্তন-প্রত্যাবর্তনের অতিরিক্ত চিন্তা ও কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে উন্নীত নন।

উপরের এই দুই ধরণের মানসিকতার কথা বাদ দিলে তৃতীয় যে দর্শন তার উদ্ভব যেহেতু ভারতবর্ষের বাইরে এবং সে দার্শনিক যখন কার্ল মার্ক্স তখন তাঁর নাম বাদ দিয়ে তাঁর দর্শন নিয়ে আলোচনা চলেনা। তেমনই ভাবে বিভিন্ন দেশে যঁদের নেতৃত্বে সে দর্শনের প্রয়োগ আংশিক ও সাময়িক সময়ের জন্যও সাফল্য লাভ করেছে সেই নেতৃত্ব ও সেই দেশে তাঁদের অনুসৃত পথ প্রসংগে আলোচনাও বাদ দেয়া যায় না। উপরন্তু যেহেতু এ দর্শন সর্বশেষ বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্বদর্শন এবং এ যুগে যখন সার্বিক ভাবে একই ধাঁচের বিশ্ব-অর্থনীতি, রাজনীতি প্রবাহিত হচ্ছে তখন তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই দর্শন নিয়ে আলোচনা করা ও পথ নির্ণয় করা সম্পূর্ণ হয়না, সার্থক হয়না। সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি পুঁজি, উৎপাদনের হাতিয়ার, উৎপাদন ও উৎপন্ন দ্রব্যের সাথে মানুষের বিবিধ সম্পর্কের গুণগত চরিত্র বিশ্বব্যাপী একএ যুগে উৎপাদিত উপকরণ, তার বৈশিষ্ট্য, ব্যবহারের চরিত্র ও নির্ভরতা বিশ্বব্যাপী ব্যাবহারিক ঐক্য স্থাপন করেছে। এই ঐক্যের পরিধির বাইরে গিয়ে মহামতি মার্ক্সের বিশ্ব-দর্শনের আলোচনা ও প্রয়োগ অসম্পুর্ণ থেকে যায়।

এতদ্‌সত্ত্বেও একটি দেশে এ দর্শনের প্রায়োগিক প্রক্রিয়া নির্ধারণের আলোচনার সময় অবশ্যই সে দেশের ভৌগলিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদির বিচার যথাযথ গুরুত্ব সহকারেই করতে হবে। এক কথায় বললে বলতে হয় বিশ্ব ও দেশীয় উভয় বৈশিষ্ট্যই মার্ক্সীয় বিশ্বদর্শনের নিরিখে বিচার  বিশ্লেষণ করেই আমাদের পথ আমাদের ঠিক করতে হবে।

[[ চলবে ]]

আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।



Friday, June 6, 2014


আমরা কোথায় যাব ? –২

“জাতীয় দল”-এই স্বীকৃতি পাওয়া ও তা ধরে রাখার প্রচেষ্টা প্রসংগ ঃ-

সংসদীয় গণতন্ত্রে অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় দলের বিশেষ মর্যাদা ও অগ্রাধিকার আছে। বিশেষত নির্বাচনের সময়ে সব রকম কর্মকাণ্ডেই জাতীয় দলগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। প্রার্থীর প্রতীক বিতরণ থেকে শুরু করে ভোটার লিষ্ট পাওয়া, সভা করা, বুথ এজেণ্টদের এবং কাউণ্টিং এজেণ্টদের সামনের সারিতে বসার অগ্রাধিকার এই দলগুলো পায়। জাতীয় দলের পর সুযোগ পায় আঞ্চলিক দল, তারপর নির্দল। সেজন্যে সব রাজনৈতিক দলই নিজেদের এই জাতীয় দলের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য সচেষ্ট হয়। কমিউনিস্ট বলে স্বঘোষিত পার্টিগুলোও এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকে। দীর্ঘ অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই সচেতনতা একটা প্রধাণ বিষয় হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই স্বীকৃতি একটা গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাম পার্টিগুলোও এই গর্বে গর্বিত। স্বতসিদ্ধভাবেই এই স্বীকৃতি ধরে রাখার জন্যও তারা সর্বদা সচেষ্ট থাকে এবং প্রয়োজনে বিবিধ কৌশল অবলম্বন করে। যে কথা সব সময়ে মনে রাখা প্রয়োজন, তা মনে রাখা হয় না।

১।     নির্বাচন কমিশন জাতীয় দলের স্বীকৃতি দিলেই দেশের মানুষের কাছে জাতীয় দলের স্বীকৃতি পাওয়া যায় না, সমগ্র জাতির দল হওয়া যায়না।

২।    রাজ্যভিত্তিক ভোটের এবং প্রাপ্ত আসনের সামান্য হেরফেরেই নির্বাচন কমিশনের দেয়া জাতীয় দল-এর স্বীকৃতি বাতিল হয়ে যায়।

৩।    প্রকৃত জাতীয় দলের স্বীকৃতি নির্বাচন কমিশন বা সরকার না দিলেও দেশ শুদ্ধু মানুষের মনে থেকে যায়।

৪। অন্য রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে দুয়েকটি আসন বোঝাপড়াকে আমি মনে করি জাতীয় দলের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যেই এই বোঝাপড়ার চেষ্টা। বিনিময়ে তাঁদের কেউ কেউ বামেদের শক্তি যেখানে বেশি সেখানে দুতিনটি আসন দাবী করেন। অন্য রাজ্যে এভাবেই পাওয়া কয়েকটি আসন ( অর্জন বা জয়লাভ বলব না) যোগাড় করাকে নেতৃত্ব সে রাজ্যে সংগঠনের বিস্তার ঘটেছে বলে ফলাও প্রচার করেন কিন্তু পরের নির্বাচনে দেখা যায় ফল উল্টো হয়েছে। এই ফাঁকিবাজি বোঝাপড়া অর্থহীন ও সুবিধাবাদের পরিচায়ক, আসল কাজে বা লক্ষ্য সাধনে নিস্ক্রিয়তার পরিচায়ক। ২০১৪-তে জয়ললিতা যখন প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, তাঁরা একটি আসনও কাউকে ছাড়বেন না তখন আসন চাইতে যাওয়া দলটির সর্বভারতীয় মর্যাদা কোথায় থাকে ?

এই আঞ্চলিক দলগুলো সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো নীতি নিয়ে চলে না। নিজেদের রাজ্যে শক্তি সঞ্চয়, জাত্যাভিমান ও নানা রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তের ভয়ে এরা সর্বদাই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের সাথে থাকে।

এতসবের পরেও প্রকৃতভাবে মানুষের মনে জাতীয় দলের স্থান অর্জনের প্রচেষ্টাকে সরিয়ে দিয়ে এই সহজে চটজলদি কিছু জুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। বৃহত্তর গণ আন্দোলনকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে এটা কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক কৌশল হতে পারেনা। বরং বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।


[[ চলবে ]]

আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।

Tuesday, June 3, 2014





আমরা কোথায় যাব ? --১ 


[[ ভাবতে যখন শুরু  করি তখন এলোমেলো ভাবে অনেক কথা চলে আসে, স্মরণ শক্তির অভাবে সেগুলো অনেক সময়ে ভুলে যাই। তাই লেখাটা কিছুটা অগোছাল হতে পারে, আগের কথা পরে, পরের কথা আগে চলে আসতে পারে। ]]

আমরা কোথায় যাব ? --১ 

আমার ভাবনা ঠিক এখন এই সময়তে এভাবে প্রকাশ করায় ভুল বোঝার যথেষ্ট সম্ভাবনা ও সুযোগ আছে। ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচন থেকে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত সবকটি নির্বাচনে সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকারী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে ঘোষিত ও পরিচিত পার্টিগুলির পরাজয়ের যা বহর, তারপর মনে হতেই পারে যে, এই পরাজয়ের ফলেই আমি এসব বলছি। তা যে নয় সে কথা আমার পরিচিত জনেরা জানেন। বিশেষত ২০১৪-র নির্বাচনের পর এই দলগুলোর অভ্যন্তরে যে কথাবার্তা-শোরগোল চলছে তারপর আশাকরি আমার এই কথায় কেউ ভুল বুঝবেন না।

কোথায় আর বলব, শোনে তো না কেউ। শোনার ইচ্ছে এবং ধৈর্য কারও নেই। তাই অনেক দ্বিধা সত্ত্বেও এখানেই শুরু করলাম।
       
      এই পার্টিগুলোকেও দেখি নির্বাচনে পরাজয়ের পর তাঁরা বিশ্লেষণ করতে বসেন। দোষ নেই। জয়ের পর তাঁরা এহেন বিশ্লেষণ করেননা, সোজা-সাপটা বলে দেন, ‘এ জয় তাঁদের সাফল্যের জয়। তাঁদের মতাদর্শ ও রাজনীতি যে সঠিক এই জয় তার প্রমাণ’।

       ২০০৯ নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে নেতৃত্ব বদলের। ২০১১-এ বিধানসভা নির্বাচনে চেষ্টা হল নতুন মুখকে প্রার্থী করার। ২০১৪-তেও এই বিষয়টাতেই গুরুত্ব দেয়া হল। পার্টির নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত সকলেই মনে করতে শুরু করলেন, নতুন মুখ আনলেই প্রার্থী জিতবে, কিন্তু কোনো স্তরের কেউ সাধারণ মানুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেননি। সে ইচ্ছেও তাঁদের ছিলনা। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে মানুষ তাঁদের সংগেই আছেন। নিচের তলার কর্মী এবং নেতারাও এ ব্যাপারে সতর্ক তো ছিলেনই না, অসতর্ক মুহূর্তেও তাঁরা মানুষের মুখের ভাষা পড়তে পারেন নি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে পারি অভিজ্ঞ মানুষেরা যাঁরা মানুষের মধ্যে থাকেন তাঁদের কিন্তু পরিবর্তনের আবহাওয়া বুঝতে অসুবিধে হয়নি, বরং একদম ঠিক ঠিক আভাস তাঁদের কাছে ছিল। তাঁরা সে কথা প্রকাশও করেছিলেন, কিন্তু সে কথা বিশ্বাস করার অবস্থাতেই কেউ ছিলনা।

       আসলে পরিবর্তন শুরু ভেতরে ভেতরে হয়েছিল আরও দু’দশক আগে থেকেই। প্রথম প্রকাশ এসে ঠেকল ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে। এই নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলের রায় থেকে সাহসের রোগ ছড়িয়ে পড়ল প্রায় সর্বত্র। পরবর্তি নির্বাচনে অপছন্দের ধাক্কা ধস নামিয়ে দিল।

২০১৪-র নির্বাচনের পর এ নিয়ে পার্টির উচ্চস্তরেনেতৃত্ব বদলের জন্য শোরগোল পড়ে গেছে। নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্ন যখন নানা মহলে এমনকি দলের অভ্যন্তরেও উঠেছে তখন একথা স্পষ্টভাবে বলা উচিত কেন পরিবর্তন ? কেবলমাত্র নির্বাচনে পরপর পরাজয়ের জন্য ?

যদি তাদের কর্মক্ষমহীনতার কথা ওঠে তবে তা আরো আগেই ওঠা উচিত ছিল। যদি অযোগ্যতার কথা ওঠে তবে প্রশ্ন, নেতৃত্ব তো আকাশ থেকে আসেন না। দীর্ঘ কাজের মধ্য দিয়ে যাচাই করে তাঁদের আনা হয়। তা হলে সেই যাচাইয়ে কি ভুল ছিল কোথাও ? শুধু নেতৃত্ব বদলই কি সমাধান ? প্রশ্ন উঠেছে কমিটি ভেঙে দেয়ার, তাহলে তো গোটা পার্টিটাকেই ভেঙে দিতে হয়! একজন, দুজন, তিনজন নেতা বা নেত্রী কর্মক্ষমতা হারাতে পারেন, ভুল করতে পারেন কিন্তু নেতৃত্বের বাকি বড় অংশ কী করছিলেন ?

আসল কথা হল, কর্মক্ষম যোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্য কমিটি, উপযুক্ত পার্টি সবই হতে পারে যদি মতাদর্শ ঠিক থাকে এবং মতাদর্শকে রূপায়িত করার জন্য সৎ ও সচেতন ধারাবাহিক কর্মপ্রবাহ থাকে। শুধু রুটিন মাফিক ধরাবাঁধা কিছু কাজ দিয়ে হয়না। আপনাদের দলগুলোতে তা ছিল কি ?  মতাদর্শের বাস্তব রূপায়নের জন্য কিছু কিছু কথা মাঝে মাঝে উচ্চারণ করা হলেও কার্যত কিছুই হয়নি। সেই বিচারে মতাদর্শ সম্পর্কে যে কোনো স্তরের নেতৃত্ব কতটা সচেতন ছিলেন, রূপায়নের প্রশ্নে কতটা সৎ ও আন্তরিক ছিলেন সে প্রশ্ন দেখা দেয়।


এসব বাদ দিয়ে যদি নীতি ও মতাদর্শের কথা ওঠে তাহলে আমার মনে পড়ছে চীনের একাদশ পার্টি কংগ্রেসের পর সেখানকার কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছিল, ‘ কমরেড মাও-সে-তুং ওয়াজ রাইট বাট আওয়ার সেন্ট্রাল কমিটি ওয়াজ রং। একথা পিপলস ডেমোক্রেসিতে আমি পড়েছি। পুরো পার্টি নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের একথা প্রসংগে অন্য আলোচনা এখানে অপ্রাসংগিক। চিনের সমস্যার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি একা মাও-সে-তুং কে দায়ী করেননি। এটাই তো হওয়া উচিত। আমাদের এখানে পার্টির অভ্যন্তরে যাঁরা নেতৃত্ব বদলের কথা বলছেন তাঁরা সে বদলথেকে নিজেদের বাদ রাখছেন কেন ? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁদের এসব কথার নেপথ্যে মানুষের স্বার্থ চিন্তা নেই, পার্টির স্বার্থ চিন্তা নেই, আছে অন্য কিছু অথবা ভ্রান্তি। 

[ চলবে ]

আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।

Friday, May 23, 2014

এ ক'দিন রাজনীতি নিয়ে অনেকের লেখা পড়লাম,। আমি একটু অন্যভাবে শুরু করি। আমার এই লেখাটা রম্যরচনার জন্যপ্রিয় পত্রিকা 'রসাতল'-র নেশা সংখ্যা (সংখ্যা সাত, অগাষ্ট ২০১২) তে প্রকাশিত লেখা। এই সময়ে এখানে তুলে দিলাম, তারপর এখনকার কথায় আসব।

>>>>>>>>>>>>>>>>

শা'......

শা... কোন বাজে কথা নয় মানে বিশেষ সূত্রে গড়ে ওঠা সম্পর্ক উচ্চারণে গালাগাল নয়, শুধু দুটো অক্ষরের সম্মেলন মাত্র। আগে বসলে শাপ-শাপান্ত থেকে অনেক কথা, শেষে বসলে পেশা থাকে পাশা, নেশা থেকে নাশা এমনও অনেক। তবে সর্ব নেশাই সর্বনাশা নয়। যেমন রসাতলের সম্পাদনা এ্যাডিকশন নয়, প্যাশন। প্যাশন যে সর্বনাশা হয়না তা নয়। প্যাশনও শারীরিক, মানসিক, বৈষয়িক-সামাজিক নানা ক্ষেত্রেই সর্বনাশা হতে পারে। নেশা নানা কারণে ও সুযোগে পেশা হয়েও দাঁড়ায়, যেমন রাজনীতি। প্রকৃত রাজনীতিকরা এটা নিয়ে গর্ব করেন। এ নেশাটাও এ্যাডিকশন নয় প্যাশন, রাজনীতির প্রতি পূর্ণ আসক্তি নিয়ে নেশাচ্ছন্ন থাকা।

নেশাচ্ছন্ন বললে ঠিকঠাক বোঝা যায়, কারণ বিপিন বাবুর কারণ-সুধা মেটায় জ্বালা মেটায় ক্ষুধা। রাজনীতির নেশার ক্ষেত্রেও তাই। সেটা মননশীল, সৃজনশীল, ধ্বংসাত্মক, অনর্থক যাই হোক না কেন ব্যক্তিবিশেষের নানা রকম ক্ষিদে মেটে। এছাড়াও উত্তেজিত হওয়া যায়, এমনকি কখনো কখনো কেউ কেউ বেসামালও হয়ে পড়েন। মোট কথা কোনো কারণে বা কোনো কাজে বোধে বা নির্বোধে, স্বার্থে বা পরার্থে জীবনপাত করে আচ্ছন্ন বা বুঁদ হয়ে থাকলেই হল।

তা, রাজনীতির নেশার কথা বা নেশার-ঝোঁকে রাজনীতির কথা বলতে গেলে নেশাচ্ছন্ন কমলাকান্তের কথা মনে পড়বেই। অবশ্য দুগ্ধলোভী মার্জারের সাথে তাঁর নেশাতুর কথোপকথন পুনরুল্লেখ না করাই বেশি নিরাপদ। তিনি যা করে গেছেন আজকের দিনে তা করতে গেলে এখনই ফতোয়া কণ্ঠরোধ এসব বলছেন, শেষে কী বলবেন এর আওতায় জেল খাটতে হতে পারে। নিষেধাজ্ঞা শেষে নেতা-নেত্রীর চাওয়া মানে অনুরোধ মানে নির্দেশ। ফলে প্রথমে সামাজিক ভাবে ত্যাজ্য পরে আইপিসি তারপর ইউএপিএ আছে, আফস্পা আছে। এস্‌মা, নাসা, মিসা এগুলো অনেক পুরনো হয়ে গেছে। যে সব লোকে পদ্যা লেখে,/তাদের ধরে খাঁচায় রেখে......  পদ্য একটা প্রতিরূপ। ওটা কার্টুন, কোলাজ, হুশেনের ছবি কিংবা লালনের গান যা কিছু হতে পারে। আমাদের স্বাধীন দেশে নজরুল রবীন্দ্রনাথের গানও শেলফের বাইরে বের করা নিষেধ হয়েছিল, কারণ নিজের রাজনীতিটা আগে। ও নেশা ভং হতে দেব না, অন্য নেশা (রাজনীতি) করতে দেবনা, কেউ সে চেষ্টা করলে দেখে নেব এবং শেষ দেখে ছাড়ব। এঁরা উত্তেজিত এবং সময়ে-অসময়ে বেসামাল হন কারণ রাজনীতি তাঁদের নেশা। কমলাকান্ত উত্তেজিত হতেন না কারণ নেশাটা ছিল তাঁর রাজনীতি।

নেশার ঘোরে বেসামাল কথাবার্তায় যাওয়ার আগে গুরু-বন্দনার মত রাজনীতির বন্দনা সেরে নিই। ধর্মীয় নেশার পর একমাত্র রাজনীতির নেশাই বিশ্বশ্রেষ্ঠ, বিশ্ব নিয়ন্ত্রক, বিশ্বপ্রিয় দীর্ঘস্থায়ি নেশা মাত্র। এ নেশাই একমাত্র যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা, লেখালেখি, কথাবার্তা, বিতর্ক, যুদ্ধ, প্রাণহানি হয়েছে এবং নেশা নিয়ে এটাই একমাত্র ইন্ডাস্ট্রি যেখানে কোটি কোটি মানুষ সাধারণত স্বেচ্ছায় অর্থ, শ্রম, বিষয়-আশয়, প্রাণ দান করে। বেশিরভাগ মানুষের এই দান মুখ্যত পরার্থে আর একমাত্র এই ইন্ডাস্ট্রিরই অন্যতম বড় সাব-ইন্ডাস্ট্রি হল যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ কারখানা। বন্দনা শেষে বুকটা বেশ ফুলে ওঠে। লেফ্‌ট-রাইট-লেফ্‌ট, লেফ্‌ট-রাইট-লেফ্‌ট......হেই-ই-ই-ল...হুপ্‌।

তা রাজনীতির প্রকৃত নেশাড়ুরা রাজনীতি করাকে দেশ-সেবার কর্তব্য বলে মনে করেন এবং একাংশ, বিশেষত যারা নেতা-নেত্রী তাঁরা দেশসেবার রাজনীতিকেই তাঁদের পেশা হিসেবে বেছে নেন। এটাই তাঁদের নেশা। খানিকটা ভুতে পাওয়ার মত অবস্থা। আর যারা শুরু থেকেই হোক কি পরেই হোক লাভের জন্য রাজনীতি করেন তাঁদের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, তাঁরা রাজনীতি-ব্যবসায়ী, ব্যাবসায়ী-রাজনীতিক। এঁরা নেতাদের তোষামোদ করা, জনগণকে সচেতনভাবে বিভ্রান্ত করা (প্রতারকের মত), যতটা সম্ভব ছদ্মরুপে নানাবিধ লাভের পথকে সুগম করা ইত্যাদিতে সুচতুরভাবে ব্যস্ত থাকেন। এটা তাঁদের নেশা নয়, উপার্জনের হাতিয়ার। নেশা ধরলেই বরং তাঁদের সাড়েসর্বনাশ ! এর পরের রাজনীতিক হলেন আংশিক সময়ের একদল রাজনৈতিক কর্মী যারা মানুষের মঙ্গলের আশায় নেতাদের নির্দেশে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন, বিরোধী পক্ষকে সহ্য করতে পারেন না। তাঁদেরও এটা নেশায় পরিণত হয়, এঁরাই সংখ্যায় বেশি। এঁদের নেশাগ্রস্ত করার কাজটা  সুচারু রূপে হয়না বলে অনেক ক্ষেত্রেই এঁরা যথেষ্ট অনিয়ন্ত্রিত। আরেক দল আছেন যারা প্রধানত নিজেকে সমাজের মান্যগণ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এটাকে মাধ্যম করেন। তাঁদের রাজনীতি না করলে চলেনা ঠিকই কিন্তু তাঁদেরও এটা নেশা নয়। এখানেই কি শেষ ? না, এত অল্পেতেই অধীর হলে নেশা হয় না। অনেকেই ইচ্ছে না থাকলেও অন্য নানবিধ কারণে রাজনীতি করেন। তাঁদের কাছে রাজনীতিটা নেশাও না, পেশাও না, তাঁরা খানিকটা পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই রাজনীতি করেন। তা কখনো চাকরি বাঁচানোর জন্য, কখনো পিঠ বাঁচানোর জন্য। কখনো ত্রাণ পাওয়ার জন্য, কখনো ত্রাণ-সাহায্য পাওয়ার জন্য, কখনো অবসর সময় কাটানোর জন্য। তা ছাড়া ঢুক্যে প্যরেছি বের্‌রিয়ে যাব্বো কোথায় বলো গোত্রের লোকজনও আছেন। হ্যাঃ, আরেন্না জনগণতো শুধু জনগণনার জন্য”। আমার এসব যাবতীয় কথাবার্তার মূল উদ্দেশ্য শুধু যারা নেশাগ্রস্তের মত রাজনীতি করে আমেজে বুঁদ হয়ে থাকেন রসাতলে পাঠাবার জন্য তাঁদের বেছে নেওয়া। এঁরা কী কী ভাবে বুঁদ হয়ে থাকেন?

(১) সমস্যা সমাধানে তত্ত্ব সন্ধানের নেশা। জিনিসপত্তর শরীর আর রসাদি ( আদি নয়) সংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের কথা বাদ দিলে মানুষের জীবনের বাকি সব সমস্যার সমাধানের জন্য ( আজ অবধি হয়নি) চিরকাল কিছু মানুষকে দার্শনিক নামক ভুতে পায়। এঁরাই রাজনীতি-নেশার সর্বোচ্চ শিখরে আছেন, যেখানে মহাদেবের জটা আছে ! ওঁদেরও আছে। দর্শনের নেশা মানে সব দেখে-শুনে এক-দ্বি-ত্রি ইত্যাদি স্তরেও কুলোয় না বলে বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে, মাথায় টাক ফেলে, পকেটের টাকা ফেলে, অথবা বড় বড় চুল-দাড়ি রেখে খণ্ডের পর খণ্ড ইয়া মোটা মোটা বেশ ভারি ভারি বইতে কঠিন কঠিন সব কথা লিখে যাবতীয় সমস্যা সমাধানের আর মুক্তির পথ বাতলে দেওয়া। পণ্ডিতের কথা তো, ফেলা যাবে না।

সহজ সমাধান অবশ্য একটা আছে, যত মত, তত পথ, কিন্তু মুস্কিল হল, ...আমড়াতলার মোড়ে/তিন মুখো তিন রাস্তা গেছে, তারই একটা ধরে... পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে...

কোনো কোনো দার্শনিক আবার এও বলেন, তাঁদের দর্শন ডগমা নয়, মূল  সূত্রগুলো ঠিক রেখে দেশকাল ভেদে আর সব পালটে নেওয়া যেতে পারে। বোঝো কাণ্ড ! এই সুযোগে আজকাল ত অনেকে সবই পালটে ফেল্লো। প্রায় নতুন করে লেখা হল, মূল সূত্রগুলো সমেত ! পাতা উলটে মনে হল সবটাই উলটো, এতদিন যা শুনে বুঝে বলে এসেছি সেসবে বস্তা বস্তা ভুল ! থাকতেই পারে। মাথায় বোঝা চাপানোর সময় আমরা আবেগের তোড়ে যদি না বুঝি যে বস্তায় কী আছে, ভুল নোট না ঠিক নোট তবে কার দোষ ? তা, লিখলি লেখ (নেশা চাপলে কী আর করা যাবে !) মূল লেখকের নামেই সব চালিয়ে দিচ্ছিস, নিজেদের নাম দেবার সাহস নেই ! মহান সব দার্শনিক আর পণ্ডিতদের নামে সব চালিয়ে দেওয়া কেন? এ কেমন চালিয়াতি বা জালিয়াতি ! কোনও নেশা না করেও আমাদের মত আজন্ম মুখ্যু মানুষদের মাথা গুলিয়ে বেসামাল অবস্থা। আবার সাহস কত বলে কিনা মানুষকে এসব বুঝতেই হবে। মামার বাড়ি আর কী, মেধার জোর ফলাচ্ছ ! পশট করে বল না বাবা আগে যা অনিবার্য ছিল তা বাতিল, যা হবে বলা হয়েছিল তা হবে না, নতুন করে লেখা হল। তা বলবে না। বললে আমরা যদি প্রশ্ন তুলি ! তা বাবা-বাছারা বুঝলে হে, আমরা ভাত মেখে খাই, ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। তোমাদের ওই মোটা মোটা বইয়ের বাণ্ডিল বাণ্ডিল বোঝা বারে বারে মাথায় নিতে পারব না। শা...। কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল রে এঁদের ? নিকুচি করেচে, আমি চলি।

বললাম বটে চলি কিন্তু আমাকেও তো নেশায় পায়। ভাবতে চাওয়ার নেশা, বুঝতে চাওয়ার নেশা। সমস্যা কুড়ে কুড়ে খায় ! ওটাতো একার না যে ‘Zআআ-ক্‌গে... বলে গড়িয়ে যাব, পাশ ফিরে শোব ! মধ্যবিত্তের মাধ্যমিক সুবিধাবাদের স্তরে থাকি। পেপ্সি-পিজ্জা তো খাইনা, সঙ্গের অনেকেই খায়। বড় লোকের দল করলেতো খায়ই, গরিবের দল করলেও খায়। কোম্পানীর ছাপ মারা বোতলের জল না হলে ওঁদের পেট খারাপ হয়, ঠাণ্ডা গাড়িতে না চড়লে কাজ করতে পারেন না, শরীর খারাপ হয়। হবেই তো, কত থিয়োরী ঘাঁটেন, (অসহায়) জনগণের কত সমস্যার সুরাহা করেন। না পারলে পথ বাতলে দেন, তাতে খুড়োর কলও থাকে, আর থাকে ...বাপরে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে। গভীর তত্ত্ব-কথাও থাকে, অর্থাৎ কিনা...গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কী করে,/রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে

দেশটা যখন স্বাধীন হল নেতারা বলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ না কী যেন করবেন ! আবার পরে শুনলাম ঐ ধাঁচের সমাজ গড়তে হলে নাকি সমাজতন্ত্রীদেরই অর্থাৎ কমিউনিস্টদেরই নিস্ক্রিয় করতে হবে। তারও পরে দেখলাম ধাঁচের পথ সুগম করার জন্য গণতন্ত্রকেই উচ্ছেদ করতে হবে। তা আবার অনেকের সহ্য হলনা, কার যে কী সহ্য হয় বোঝা মুস্কিল তো ! এত মহামতবিরোধ যে, কেউ একটা কিছু করতে গেলেই তা সে ভাল হোক আর মন্দই হোক বাকিরা চারদিক থেকে রে-রে করে তেড়ে আসে (হাতে লাঠিসোটাও থাকে)। আসলে চরম উত্তেজনা।এই নেশাটা না করলে রাতে তাঁদের ঘুম হয় না। জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধেও মানুষ উত্তেজিত হয়ে (হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও) প্রচণ্ড হই-চই করল। সে কী চিৎকার। চিৎকারের ভয়ে জরুরী অবস্থা উঠে গেল ! হ্যাঃ, ফের শুরু হয়ে গেল গণতন্ত্র। এতটাই গণতন্ত্র যে সবেতেই উদারতা। উদার অর্থনীতি, উদার শিল্পনীতি, কৃষি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য সবেতেই উদারনীতি। এদেশী কি বিদেশী কে নিবি আয়, যা নিবি নিয়ে যা, যতখুশি নে। আর যায় কোথায়, অমনি একদল বলতে শুরু করল এত উদার হওয়া চলবে না, চলবে না। উদারবাদীরা এসব হবে জানেন, তাই কানে তুলো গুঁজে উদারতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলেন। কিন্তু এ রোগ বড় ছোঁয়াচে রোগ। প্যাশনেট মানুষেরা তাঁদের কাজে নিজস্ব শৈলী বজায় রেখেও অনেক সময় পুরনো ফর্ম ভেঙ্গে নতুন ফর্ম সৃষ্টি করেন। এই সার্বিক উদারতার ফলে হল কি, যারা একেবারে কঠোর বা কট্টর ছিলেন তাঁরাও কেমন যেন উদার হয়ে গেলেন। কদিন আগে শুনছিলাম একটাও নাকি লাল ঝাণ্ডা থাকতে দেওয়া হবে না, আবার শুনছি তাঁরাই মে-দিবস পালন করছেন। লালঝাণ্ডা ছাড়া মে-দিবস হয় নাকি ? আবার শুনছি তাঁরা নাকি যারা মে-দিবসের লাল ঝাণ্ডা তুলতে গেছিল তাদের কাকে কাকে খুন করেছে। আকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে/দেখে চেয়ে কত লোকে সব কাজ ফেলে/ তাই দেখে খুঁৎ-ধরা বুড়ো কয় চটে/ দেখছ কি, এই রঙ পাকা নয় মোটে।

সমাজতন্ত্রীরা আগে বলতেন---পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, ব্যক্তিপুঁজির উচ্ছেদ, বিদেশী ও একচেটিয়া পুঁজির জাতীয়করন, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব, শোষণ ও পুঁজি সৃষ্টিকারী বাজার অর্থনীতি বন্ধ এরকম আরো কী কী সব। এখন আবার তাঁরাই বলছেন বাজার থাকবে, ব্যক্তিপুঁজি থাকবে, একনায়কত্ব হবে না, বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকবে, বৃহৎ পুঁজির বিকাশ ঘটাতে হবে ইত্যাদি।...খাপ পেতেছেন গোষ্ঠ মামা/... এইবার বাণ চিড়িয়া নামা---চট্‌/ওই যা ! গেল ফস্কে ফেঁসে--- হেই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে ? আগে শুনতাম শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব আর উৎপাদন-বাজারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ। এখন শুনি---না না, ওটা ভুল। যারা ও পথে গেছে তাঁরা টিঁকতে পারেনি, যেমন সোভিয়েত রাশিয়া। তাই বহুদলীয় গণতন্ত্র চাই। সর্বহারার একনায়কত্ব নয়, চাই সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা (মানেটা কি ? বহুদলীয় ব্যবস্থায় টিঁকবে তো ?) এর পরে আর কিছু মনে রাখতে পারিনি, সব ভুলে মেরে দিয়েছি। সমাধান আদৌ আছে কিনা, থাকলে ঠিক কোন পথে, কোথায় তা বুঝতে পারিনা, এঁদের ধাঁচও বুঝতে পারিনা। তবে হ্যাঁ আমার মাথা একটু কম বলে গুলিয়ে ফেলা আমার সহজাত আর ভুলে মেরে দেওয়া আমার বেশি বয়সের প্যাশন মানে নেশা মানে...(কেউ বারণ করলেও শুনছি না)।

(২) আদর্শের নেশা। বলেছিলাম চলি কিন্তু ঐ যে বললাম না, হাজার বার চলি বলেও রেহাই নেই। স্কুলে পড়তে গেলে, কলেজে পড়তে গেলে, অফিসে চাকরি করতে ফেলে, পাড়ায় থাকতে ফেলে, বাড়ির বাইরে বেরোতে গেলে আদর্শের নেশাগ্রস্তদের পাল্লায় পড়তে হবে। এঁরা আদর্শের বানে সাঁতরে এসেছেন (আমরা ভেসে)। তাই এঁরা আদর্শবান এবং আদর্শবাণ। আবার এঁরা বাণবিদ্ধও বটে ! সব বাণ তাঁদের ডেকাড্রন-এর মত রি-ভাইট করে। শিক্ষা তো দান করলে বাড়ে। আদর্শবানেরা মানে আদর্শে নেশাগ্রস্তেরা নিজেদের শিক্ষা, ভোট এবং সংগঠন বাড়াবার জন্য, মিছিল সমাবেশে গণবৃদ্ধি করে বিপক্ষকে শক্তি দেখাবার জন্য আদর্শের বাণ তুণে ভরে একজন একজন করে বহুজনকে বাণবিদ্ধ করবেন। তোমাকে পাকড়াও করে মর্মস্পর্শী স্বপ্ন দেখাবেন। তুমি চাচা পা-লা বলে পালাতে পারলে বাঁচলে, নয় তো গেলে। আয় তো দেখি, বসতো দেখি এখেনে বলে ধীরে ধীরে তোমাকেও এঁরা নেশারু বানিয়ে ছাড়বেন ! আদর্শের জন্য এঁরা মা-বাবা-বউ-ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি-বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-স্বজন-ঘর-বাড়ি সব ছাড়তে প্রস্তুত। এত কিছু ছাড়লেও তাঁরা তাঁদের নেশা ছাড়বেন না। অন্য সব নেশারু এঁদের কাছে হার মানতে বাধ্য। মাথা ঝিম ঝিম করছে ? একটু তামাক খাবেন ?

(৩)  তাত্ত্বিক হওয়ার নেশা।  এ বড় মারাত্মক কঠিন নেশা। মারনাত্মকও বটে। অনেক কষ্ট করে আয়ত্ত্ব করতে হয়। এ নেশায় আসক্ত হওয়ার হাতছানি আছে কিন্তু সবাই হজম করতে পারেন না। এ নেশায় আক্রান্ত কারা ? রাজনীতির নেশাগ্রস্তদের সংগে একটু মেলামেশা করুন তবে তো বুঝতে পারবেন এঁরা কারা। যারা নিজেদের একটু নেতা-নেতা ভাবেন তাঁরা এটা করার চেষ্টা করেন। প্রথম প্রথম সকলেই একটু-আধটু বিষম খান, কাশি হয়, মাথা ঘোরে। কেউ কেউ পরে ধাতস্থ হয়ে ওঠেন, ঝানু নেশাড়ু হন। যারা হতে পারেন না, হয়তো কোনওদিন হতে পারবেন না তাঁরাও কিন্তু সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নন। তাঁরাও যে তাত্ত্বিক সেটা তাঁরা প্রমাণ করেই ছাড়বেন। আর যারা ঝানু তাঁরা সুযোগ পেলেই ...এই মনে কর রোদ পড়েছে ঘাসেতে,/এই মনে কর, চাঁদের আলো পড়লো তারই পাশেতে--- শুরু করে দেবেন। বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সুক্ষ্ম হতে স্থুলেতে... আমার মাথা কেমন যেন হচ্ছে।


(৪) বক্তৃতার নেশা। ওরে সর্বনাশ ! সে এক হাস্যকর নেশা। বক্তা হতে হবে, কারণ তিনি জন-সমক্ষে বিশেষভাবে পরিচিত হতে চান, দলে কদর পেতে হলে আর মানুষের আদর পেতে হলে বক্তৃতাই একমাত্র উপায়। নেতা অথচ তিনি বক্তৃ করতে পারেন না এটা কেমন ? তাই পারুন না পারুন, কেউ শুনুক না শুনুক কিংবা শুনে পেট চেপে হাসুক, বিরক্ত হোক... যা ইচ্ছে করুক তিনি বলবেনই এবং অনেক্ষণ বলবেন।


ভোট এলে ভাবি এত ভয়ংকর সব আগ্নেয়গিরির এত উৎপাত এত দিন চাপা পড়ে ছিল ! শাখা-প্রশাখা ছোট বড় সমস্ত শিখর থেকে সে কী অগ্ন্যুৎপাত ! একে অপরের দিকে ছাই ছুঁড়ে চাপা দিতে চাইছে, চাইছে যাতে দম নিতে না পারে। করবই করব বলে কে কত বড় লিস্টি বানাতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে, ফলে চতুর্দিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন। বড় জনসভায় বলতে না পারলে উচ্চশিখরেরা বলেন আমাকেতো তোমরা ডাকোই না, পথসভায় ছোটরা বলে দেখেছ, আমাকে বলতেই দিল না, ঘরোয়া সভায় ক্ষুদ্র শিখরেরা বলতে না পেলে মন খারাপ করে। ফলে ঘরোয়া সভা গুলোতে স্রোতার চাইতে বক্তা বেশি। মাঠে ময়দানে তো মারাত্মক অবস্থা। একই মাঠে ডেকরেটর আজ এর ম্যারাপ বাঁধে তো কাল ওর ম্যারাপ বাঁধে। মাইকের সংখ্যা আগের দিনের চাইতে বেড়ে যায়। এসময়ে চলে রাজনীতির ষোল আনা নেশা করার উৎসব। বক্তাদের ফাইনাল পরীক্ষা হয়। আচ্ছা, দয়া করে একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ কি দেবেন ? ছাড়া-পাগল যদি নেশা করে তবে তার পাগলামো কতটা বাড়ে ? দেশসেবক (দেশ-সেবক)-রা কাজ পাগল হন। এবং তাঁরা বদ্ধ থাকেন বলে কখনো শুনিনি।

(৫) নেতা হওয়ার নেশা। এটা মানুষের জন্মগত প্রধান নেশা কটির মধ্যে অন্যতম। ইংরেজীতে যেমন টপার হওয়া বলে। উঁচুতে ওঠো, সর্বোচ্চে ওঠো, বিজয় অর্জন কর, বাহবা পাও এবং যারা পারল না তাদের শাসন কর, পরিচালনা কর। এ নেশা না থাকলে মহা মহা দুর্যোগ পেরিয়ে সবাইকে টপকে এই প্রজাতি মানুষ হতে পারতো না। লাফিয়ে বন্য ঘোড়ার পিঠে উঠতে আর মাঝে মাঝে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙতে কে বলেছিল ? পেছনে ছুটে ঘোড়ার লাথি কি বেচারা কম খেয়েছে ! শরীরের সাথে রক্তের, রক্তের সাথে নেশার যে সম্পর্ক রাজনীতির সাথে নেতা হওয়ার সম্পর্ক ততটাই জড়িত, অচ্ছেদ্য।অনেকেই আছেন যাঁরা নেতা হওয়ার জন্যই রাজনীতি করেন। তাঁরা সোজাসাপ্টা বলেন, প্রমোশন পাওয়ার জন্যই তো কাজ করা। রাজনীতি করার পেছনে তাঁদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। বাকিদের তো রাজনীতিতে এসে নেতা ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে। নেতা হওয়ার নেশা না থাকলেও অনেকে স্বভাবগুণে নেতা হন। তাঁদের একটা বড় অংশ তারপরেও সাধারণের মতোই থেকে যান, অল্প কয়েক জন নিজেদের হনু ভাবেন। যাইহোক, স্বভাব নেতার নেতৃত্ব নেশা অনায়াস ছন্দে রক্তে মিশে যায় আর প্রতিযোগী নেতার নেতৃত্ব-নেশা সচেতন ভাবে অভ্যাস করতে হয়। সে জন্যে কাজ করার সাথে সাথে তাঁদের আরও কোন কোন গুণাবলি আয়ত্ব করতে হয়। যেমন টুকুস করে অন্য প্রতযোগিদের পা চেপে দাও। সে এক মহা-সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা ! ল্যাঙ মার। পেছন থেকে, সামনে থেকে, পাশ থেকে, প্রকাশ্যে, লুকিয়ে-চুরিয়ে যে ভাবে পার ল্যাঙ মার (নিজের ঠ্যাং শক্ত না হলে অন্যকে দিয়ে)। কেন, তা না হলে নেতা হওয়া যায় না ?যায় রে বা যায় কিন্তু তার জন্য তো কাঠ খড় পোড়াতে হয়। জানতে হয়, সময় দিতে হয় দায়িত্ব নিতে হয়, কাজ করতে হয়, বুদ্ধি রাখতে হয়। ঠিক ঠিক যোগ্যতা না থাকলে নেতা হবি কেমনে ? ঠিক যায়গা মত তেল আর সন্দেহ আর টুকলি না চুকলি কী বলে সেসব আর সঙ্গে চক্রান্ত। অথবা যারা সত্যি নেতা, মানে এসব ছাড়াই নেতৃত্বে উঠে আসেন তাঁদের বিশেষত বড়দের যথাযথ সম্মান দিতে শেখ। আড়ালে আবডালে আজেবাজে ঠাট্টা কথা যাই বলনা কেন জনসমক্ষে কখনো বোলো না বরং একটু খুশি রেখ (হেঁ হেঁ, আপনি হলেন গিয়ে সব, আর কে আছে !)। আর প্যাঁচ-পয়জারটা একটু ভাল করে বুঝে নিও, আয়ত্ব করে নিও। নেতাদের মধ্যে যারা ঠিক প্যাঁচ-পয়জার বোঝেন না তাঁরা হঠাৎ অবাক হয়ে খেয়াল করেন তাঁর জায়গাটা নড়বড় করছে। কাজেই শুধু নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকলেই হয় না। প্যাঁচ-পয়জার বুঝে নিজের জায়গাটা ঠিক রাখতে পারেন নি এটাই তাঁদের অযোগ্যতা।

(৬) সংগঠন গড়ার নেশা। এটা এক ধরণের কিডন্যাপিং-নেশা। স্কুল থেকে ছেলেগুলোকে ধরে কে যেন কোথায় নিয়ে গেল কেউ জানে না। ছেলেরা জানেনা, বাড়ির লোক জানে না, মাস্টার মশাইরা জানেন না  কিন্তু গেল। কিডন্যাপিং ছাড়া কী ? তারপর যন্তর-মন্তর ঘরে চালান করে দাও। মগজ ধোলাই হবে। এরপর রইল কলেজ, পাড়া, কারখানা, অফিস, চাষবাস, সংগঠিত, অসংগঠিত কত কী। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে এদের নিয়ম শেখাও, শৃংখলা শেখাও,আনুগত্যের নামে বশ্যতা শেখাও। এক কথায় এদের দলীয় করে তোল। দলে না ঢুকলে অভয় দিচ্ছি, শুনছো না যে ? ধরব নাকি ঠায়াং দুটা ?/ বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা ! (পাড়ায় থাকি। মারবে না তো, ধরবে নাতো কলার চেপে ?)।

হ্যাঁ এ ব্যাপারে একটা কথা সব্বার জানা উচিত। এই যে সবাইকে ডেকে-ডুকে আনতে হয় তার জন্য পয়সা খরচ হয় বইকি, হ্যাঁ হ্যাঁ পকেটেরই। অল্পসল্প এটা ওটা খাওয়াতে হয়, গাড়িভাড়া দিতে হয়। অভাবী ঘরে আরও কিছু সাহায্য দিতে হয়। মাঝে-মধ্যে সে জন্যে চাঁদাও তোলা হয়। এ তো ঐ কী বলে গিয়ে, রাজনীতির নেশা। আর এই নেশাটা যখন ওদেরও ধরে যায় তখন ওরাই আবার নিজের মত করে একই কাজ করতে থাকে। এস ওয়াজেদ আলি। নইলে জীবন সচল থাকে না, ইতিহাস তৈরী হয় না। তাই ভুল করেও এ নেশাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না, অবহেলা করবেন না। এ নেশা জীবনদায়ী এবং জীবন-দায়ি নেশা।

(৭) সকলের কাছে নিজেকে জাহির করার নেশা। এটা হল দলীয় মুখপাত্র হওয়ার ও বিবৃতি দেওয়ার নেশ। কে না চায় ? যারা চায় না তাঁরামুর্খ দি ইনফিনিট। আরে বাবা বিজ্ঞাপন ছাড়া বানিজ্য হয় না, তা সে যত ভাল মাল-ই হোক না কেন। আজকাল তো সোনায় সোহাগা ! বৈদ্যুতিন মাধ্যম তো প্রায় সব ঘরে, যেখানে বিদ্যুৎ সেখানেই বৈদ্যুতিন ! আনপড় মানুষও দেখে শোনে। কত সহজে, কত কম সময়ে লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে বৈঠকখানায় বসে পরিচিত হওয়া যায়। আঃ, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে ?বাড়ির লোক, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, দলীয় কর্মী, বিদলীয় কর্মী, নির্দলীয় কর্মী, নিষ্কর্মী, থানা, স্বেচ্ছাসেবি, পূজা কমিটি সকলের কাছে ওজন বাড়ে। শেতলা পূজার সিন্নি খাওয়ার নেমন্তন্ন পর্যন্ত হয়। তবে কখনো কখনো বিপদে পড়তে হয়। বেফাঁস কথা একবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলেই হল, কৃষ্ণেরও সাধ্য নেই রক্ষা করবেন। তা ছাড়া কিছুদিন আগে কোনও এক দলে বলা নেই কওয়া নেই ছোট বড় যে যেখানে পারে বিবৃতি দিতে শুরু করল। অন্তর-কলহ বাতাসের বিশেষ উপাদানে ভর করে অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে পড়ল। অম্নি নেতা নেত্রীগণএসব হচ্ছেটা কী ? হুংকারে মা দুর্গার মত অনেক ওপরে বড় বড় তিনটে চোখ কটোমটো করে খড়্গ না ত্রিশুল না চক্র কোনটা ছুঁড়বেন ভেবে না পেয়ে শুধু ফোঁস করলেন। তাঁরা একবারো ভাবলেন না নিজের মুখটা চেহারাটা বার বার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে টেরিয়ে ভালভাবে দেখার ইচ্ছে কার না করে? এর জন্যি তো আগে ছিল জলদর্পণ তারপর কাচের আয়না তারপর হল ফটোগ্রাফি তারপর চলচ্ছবি। সাদাকালো রঙচঙ চলছে ফিরছে কথা বলছে----যেন জীবন্ত ! তাই যদি না হবে তো মঞ্চে এ্যাত্তো লোক ওঠে কেন ? এ ইচ্ছেটা তো নেশাই না কী ! নইলে পাড়ায় যে দাম, মানে জনপ্রিয়তা বাড়ে না, নিজেকে কেমন একা-বোকা মনে হয়। দিনের শেষে কেমন যেন একটা অবসাদ চেপে বসে, চারদিক কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, ভেঁউ-উঁ-উঁ করে কান্না পায়। পরদিন সকালে উঠে কাজ করার মত এনার্জি মানে উত্তেজনা হয় না। স্টিং অপারেশন না কি যেন একটা হচ্ছে আজকাল, সেটা না থাকলেই হল। একটু বুঝবেন না যে ওই হতচ্ছাড়া সাংবাদিকরা একের পর এক এমন সব প্রশ্ন ছুঁড়তে থাকে যেন শ্যাম্পেনের বোতল এগিয়ে দিচ্ছে, ওঃ। ফলে দু-এক সময় হয়তো স্লিপ করে যাই (পদস্খলন না), বেসামাল হই। কীর্তনীয়ার মত মাথা দুলিয়ে সুর করে ছন্দ মিলিয়ে ভুলভাল বলে ফেলি। তা এরকম অভিজ্ঞতা তো আপনাদেরও অহরহ হয়। আপনারা অভ্যস্ত বলে সামলে নিতে পারেন। আমাদেরও তো শেখা দরকার, অভ্যেস করা দরকার, না কি বলুন। আপনাদের সব কথাই তো আমরা শুনি (যখন বলে তখন, তারপর আর মনে রাখিনা)।  এই নেশার ব্যাপারটাও কি তেমনই করব ম্যাডাম-স্যার ? রাসটিকেট করে দেবেন না তো ? দাদু বলেছিল আমার কপালে নাকি রাজটীকা আছে !

(৮) কূটনীতির মাধ্যমে শান্তি ও বন্ধুত্ব রক্ষার নেশা। এ নেশার মূলে থাকে ব্যবসা ও দেশের নিরাপত্তা। বড় দেশ যারা বিশ্বজোড়া ব্যবসা বাণিজ্য করে, যুদ্ধ করে, যুদ্ধ থামায়, অস্ত্র বেচে, সম্পদ দখল ও লুট করে তারা দেশ প্রধান কূটনীতিক দূত ছাড়াও প্রত্যেক বিষয়ের আলাদা আলাদা দূত রাখেন। তাঁদের সঙ্গে ঐ বিষয়ে একদল বিশেষজ্ঞ থাকেন। প্রধান রাষ্ট্রদূত দান-অনুদান উপঢৌকন নিয়ে বেশ হাসিহাসি মুখে ভৌগলিক, রাজনৈতিক, বৈষয়িক অবস্থান অনুযায়ী বিদেশে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের দেশের ব্যবসার ক্রেতা ঠিক করা। ক্ষুদ্রার্থে সেলসমান ভালভাবে বললে সেলস এক্সিকিউটিভ। বেবিফুড থেকে সাবান, তেল থেক কামান, গাড়ি থেকে উড়োজাহাজ সব বিক্রী হয়। সবচাইতে মজা হল এসব কেনাকাটির জন্য ওরাই আবার টাকা দেয় ! ভাল ছেলের মত যাতে কথা শুনে চলে যারপরনাই সে চেষ্টা হয়। কৃত্রিম হলেও থাকে হাসি, রাগ, দান-খয়রাত, দর কষাকষি, প্রতিবেশী শত্রুদেশের প্রতি সাবধান-বাণী, কিছু প্রতিশ্রুতি এবং অবশেষে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন ও যৌথ বিবৃতি। এই প্রচেষ্টায় যদি কাজ না হয় তবে বিশেষ কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞ দল প্রেরণ। প্রশাসন আর ব্যবসাকে নিজের মতো করে সাজাবার জন্য অভ্যন্তরীণ চক্রান্তও এর অন্যতম অঙ্গ যাকে অন্তর্ঘাতও বলা যায়। এটা রাজনীতির গভীর ও জটিল নশা। আপনিও ঠিকমত আয়ত্ব করে পাড়ায় প্রয়োগ করতে পারলে খুব ভাল থাকবেন, ধরা না পড়লে তো কথাই নেই।


(৯) দেশ গড়ার নেশা। নন্দলাল তো অনেকদিন আগে স্বদেশের তরে নিজের প্রাণ রক্ষার প্রাণ-পণ প্রচেষ্টা নিয়েছিল। ওটা ব্যাঙ্গাত্মক দেখে মোটামুটি সবাই ঠিক করল, ঊল্টোটা করতে হবে। না হলে সুইস-ব্যাঙ্কে ব্যালান্স বাড়ে যার কোন হিসেব পাওয়া যায় না ! কত আয় হলে দারিদ্র সীমার এপার-ওপার করা যায় কিংবা কতটুকু আয়ে খাওয়া না খাওয়ার মাঝখানে থাকা যায় জানেন কি? আপনি কি ডলার দিয়ে কলমি শাক কেনেন ? কেন চেপে যাচ্ছেন ভাই, নিশ্চয়ি আপনি কেনেন ! আর সেজন্যে আপনাকে খরচ কমাতে হবে কারণ আপনার জন্য দেশ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমেছে, তাই টাকার দাম কমেছে, তাই আপনার দামও কমেছে, তাই জিনিসের দাম বাড়ছেই, তাই আপনি কম খরচ করবেনই, তাই.........। বিদেশে জিনিসের দাম বাড়লে আমাদের এখানেও বাড়ে কারণ আমাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। বিদেশে দাম কমলেও আমাদের দেশে বাড়ে কারণ তখন আমাদের টাকার দাম কম থাকে। আমি অঙ্কের ছাত্র ছিলাম না, আমার কাছে অঙ্কটা বুঝতে চাইবেন না। শুধু খেয়াল রাখবেন আপনার জন্য দেশকে ডলার দিয়ে যেন কিছু কিনতে না হয়। মনে রাখবেন আপনারা খাচ্ছেন বেশি, তাই মুদ্রাগুলো স্ফীত হচ্ছে। এসব বন্ধ করুন, আমাদের কথা শুনুন। দেশ গড়ার এবং রক্ষা করার দায়িত্ব যখন আমাদের, তখন কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হবে। কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে সে সব। অসুখ হলে তেতো ওষুধ খেতে হয়, ------ আসুন খাইয়ে দিই !


(১০) দেশ দখলের নেশা। এ নেশার আরেক নাম পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করা, গায়ে পড়ে ঝগড়া করা। দোষ নেই তবু আছে কারণ আমি বলছি আছে তাই আছে, সুতরাং শাসন করতে হবে, শিক্ষা দিতে হবে। বড় বড় দেশগুলো জোট বাঁধে আর নির্ভরশীল দেসগুলো পেছন পেছন যায়। জাহাজে করে, প্লেনে করে লাখে লাখে সর্বোন্নত অস্ত্রধারী সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষক বাহিনী অবাধ্য দেশের মাটিতে নেমে গেল, আকাশে উড়ে বেরাল। গুলি ছুঁড়ল, বোমা ফেলল, আগুন ধরাল, মানুষ মারল অবশেষে সে দেশটা নাকি ভাল হল। দেশটার বেশ ক্ষতি হল, মানুষগুলো মরল তাতে কী করা যাবে, শান্তি না ফেরা অবধি শিক্ষক সেনা সেখানে থাকবে। বিশ্ব-রাজনীতির শীর্ষকর্তারা যে কোনও প্রান্তের যে কোনও দেশের গণতন্ত্র-শান্তি-সমৃদ্ধির দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে রেখেছেন। মন্দ লোকে একে ইজারা নেওয়া বলে কিন্তু এ নেশা ছাড়া তাঁদের দিনগুলো পান্‌সে লাগে, নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ এ নেশাকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেয় না ঠিকই কিন্তু বাধা দেওয়ার জন্যও সক্রিয় হয় না। তাই তাকে পাত্তা দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না। উপরন্তু যে কোনও ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জ তো বিশযুদ্ধবাজদের ওপরই নির্ভরশীল। আগে তো সকলের নেশাটা হোক।


(১১) মধ্যস্থতা করার নেশা। চিরকালীন বহুল প্রচলিত নেশা। ভেতরে বাইরে যখনই কোনও রকমের বিরোধ বা যুদ্ধ শুরু হয়, কিছুতেই মীমাংসা হতে চায় না, তখন একদল মানুষ আছে যারা উভয় পক্ষের হয়ে মিটমাট করতে আসেন। কার কিসের ঝগড়া কে মেটায় ! শত্রুর শত্রু আমার মিত্র---এটা তো বরাবরই আছে। তখন মধ্যস্থতাকারীর দরকার হয় না। দু পক্ষই ... মিথ্যে কেন লড়তে যাবি ?ভেরি-ভেরি সরি, মশলা খাবি ? আর কাজ ফুরোলে কী হয় আমরা তো তা জানি ! এ্যায় ! পায়জামো বন্ধ কর, আত্মপক্ষ সমর্থন না, আত্মসমর্পণ কর--- নইলে---! নইলে কী--- হে ঈশ্বরসম ? নইলে আমি আছি। গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে---। তারপর তো চলল এনকাউন্টার, আহতের পলায়ন, আত্মসমর্পণ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।তাই মধ্যস্থতা শেক্‌হ্যাণ্ড আর দাদা বল, সব শোধ বোধ ঘরে চল্‌। তা এ অবস্থায় যদিও সাফল্য অনিশ্চিত তবু মধ্যস্থতাকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন এটাই তো স্বাভাবিক। কী করবেন তাঁরা ? তাঁরা বলেন, ছায়া ধরার ব্যবসা করি তাও জাননা বুঝি ?...।  আচ্ছা বলুন তো, সব পক্ষ থাকবে আর ওঁরা থাকবেন না তাও কি হয় ? ওঁদের কি নেশা করার কোন অধিকার নেই ? মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ। আইনসভায় তাঁদের মনোনীত করা উচিৎ। সেখানে তাঁরা সরকার পক্ষ বিরোধী পক্ষ ঝগড়াটে পক্ষ মারকুটে-ভাঙচুরে পক্ষ সবার মধ্যে দাঁড়িয়ে মধ্যস্থতা করবেন। এ নেশাও তো দরকার । তা হলে লোকসভা চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারে বেশ বৈচিত্র আসে, একটু রিলিফ পাই ! রিলিফ না থাকলে আর্ট হয় না, নেশা তো একটা আর্টই ! এ প্রস্তাবটা মন্দ নয়। অধমের অনুরোধ কি রাজনীতির পাঁড় নেশাড়ুরা রাখবেন ! 

(১২) দল বদলের নেশা, নতুন দল গঠনের নেশা। বোধহয় সর্বশেষ নেশা, নেশা জমে যাওয়ার নেশা। গত পড়শু অবধি গাঢ় নেশারু বাবুকে যে দলের নেতা বলে জানি, কাল থেকে শুনছি---উনি যাবেন যাবেন যাবেন...এই গেলেন বলে। আজ রাতে শুনলাম উনি চলে গেছেন অন্য দলে নয়তো তিন জনের একটা নতুন দল গড়লেন ( সেক্রেটারি, প্রেসিদেন্ট, ট্রেজারার)। কারণ আগের দলের ছিলিমটা পুরনো হয় গেছে ! তাই যদি না হবে তবে এ দলেও রাজনীতি সে দলেও রাজনীতি, দল বদলের দরকারটাই বা কি আর নিষেধাজ্ঞাই বা কেন ! অথচ এসব নিয়ে আইনসভা তো বেড়ে চোখ লাল করে বসে আছে ! দলত্যাগ-বিরোধী আইন। ওঃ, নেহাত সংসদে ছাপার ভুলের ভুত চাপে না তাই রক্ষে, নয়তো সবার পেট ফুলে...নাক চেপে...দুঁর্গন্ধঁওঁওঁ......! আসলে সবই দল করার নেশায় পাওয়া মানুষদের ইচ্ছে বা আপত্তির ফল ! আইনসভাগুলোতে সবাই নির্দল হলে ক্ষতিটা কী ? ধরাবাঁধা নেশাটা ছুটে যাবে তাই ?


রীতিমত ভয় করছে, যদিও “ভোলে বাবা পার করেগা” তবু আর এগোনো উচিত হবে না। এই কেতাবে “সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনাকো লেখা কোথায়-- / পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন ক’রে ঠেকাব তায় !”

দেশী গরুটা যে কার ? শা’--- ।
                     ......
আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।