আমরা কোথায় যাব ? --৩
মতাদর্শের প্রশ্নে আমাদের এখানকার পার্টিগুলোর
অবস্থান জন্মলগ্ন থেকেই বড় অদ্ভূত !
প্রায়সই একটা কথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনীতি
নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন এমন মানুষের কাছ থেকে শোনা যায় যে, ভারতের কমিউনিস্ট
পার্টি, আন্দোলন ও বিপ্লব ভারতীয় বৈশিষ্টের মধ্যেই থাকতে হবে। বিশ্বব্যবস্থার
প্রেক্ষিতে বা কোনো দেশের অনুকরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে হবে না। এ জাতিয় কথায়
যথেষ্ট সারবত্তা থাকলেও এ প্রশ্ন উত্থাপন করা অত্যন্ত সংগত যে, আন্তর্জাতিক
বিপ্লবী ঘটনাবলি ও বিশ্বদর্শন বাদ দিয়ে কি সাম্যবাদী বিপ্লবের ভাবনা, পরিকল্পনা,
প্রয়োগ সম্ভব ? আমাদের তো ঠিক করতে হবে, আমরা কি শ্রমিক কৃষক ও সমাজের অন্যান্য
অংশের সমস্যা-জর্জরিত মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার আশু ও আংশিক সমাধান দাবীর
আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছি ? অথবা আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি এই সমস্যা
সমুহের চূড়ান্ত সমাধানের আশায়, যে ব্যবস্থা এর মূলে রয়েছে তাকেই উৎপাটিত করে নতুন
এক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বকালেই অগ্রসর হব ? নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় কোনো
মানুষই প্রথম পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইবেন না। যাঁরা প্রথম পর্যায়েই সন্তুষ্ট
থাকতে চান তাঁরা অন্য কোনো দর্শনের কথা চিন্তা করার চাপ নিতে চাইবেন না। কারণ, হয়
তাঁরা প্রকৃত অর্থে বোঝেনই না যে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে তাঁদের সমস্যার
বীজ অথবা বুঝেও এই ব্যবস্থার সাথে আপস করে চলতে চান। তাঁরা বর্তমান ব্যবস্থার
মধ্যেই কিছুদিন এক অংশকে ক্ষমতায় বসানোর পর আবার আরেক অংশকে ক্ষমতাসীন করেন এবং
কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা তৃতীয় কোন শক্তির সন্ধান করে। সে জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেন।
দীর্ঘ অপেক্ষায় তাঁরা এতটাই ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন যে, প্রথমে তাঁরা আঞ্চলিকভাবে ছোট ছোট
সংগঠন গড়ে তোলেন এবং কিছুদিন পরে বর্তমান শক্তিগুলির মধ্য থেকেই পারস্পরিক
বোঝাপড়ার মাধ্যমে অপর একটি নতুন জোট গড়ে ওঠে এবং মানুষের আস্থা অর্জন করে। ক্রমাগত
এই অবস্থার আবর্তন-প্রত্যাবর্তন চলতেই থাকে। আমাদের দেশে ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে
রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে এই অস্থিরতা বেশি বেশি করে দেখা যাচ্ছে। জনগণ তো বটেই,
রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৃহদংশের চেতনাও এর চাইতে উন্নীত হতে পারেনি। এর প্রমাণ আমরা পাই
প্রায় সব রাজ্যেই কখনও স্থানীয় দাবীকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের পর, আবার কখনও অন্য রাজনৈতিক
দলের বিরোধীতা করেই এক বা একাধিক আঞ্চলিক দল গড়ে ওঠার মধ্যে। পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয়
স্তরে এই আঞ্চলিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ক’রে ক্ষমতা ভাগাভাগি ক’রে একটি সর্বভারতীয়
জোটে সম্মিলিত হন। কিন্তু তাঁরা কখনই এই ব্যবস্থাটাকে ভাঙ্গতে চাননা, বরং নানাবিধ স্বার্থের
সঙ্ঘাতে তাঁদের নিজেদেরই সেই জোট ভেঙে যায়। এদিক ওদিক সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও মূলত
সাধারণ মানুষের দুর্দশা চলতেই থাকে।
সামজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চিন্তার ধারে কাছেও
ঘেঁষেন না, শুধুমাত্র আধ্যাত্মবাদী মত ও পথেই থাকেন এমন মানুষের সংখ্যা এতই কম যে
তাঁদের দর্শন নিয়ে আলোচনা এখানে অপ্রাসংগিক। তবু নিজ নিজ ধর্মে গভীর বিশ্বাস রাখেন
আবার সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করেন এমন মানুষের সংখ্যা যেহেতু
সর্বাধিক তাঁদের প্রসংগেও আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। নির্দ্বিধায় বলা যায় তাঁরা এক
অদ্ভূত দ্বৈত মানসিকতার মানুষ। তাঁরাও উপরে আলোচিত আবর্তন-প্রত্যাবর্তনের অতিরিক্ত
চিন্তা ও কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে উন্নীত নন।
উপরের এই দুই ধরণের মানসিকতার কথা বাদ দিলে তৃতীয়
যে দর্শন তার উদ্ভব যেহেতু ভারতবর্ষের বাইরে এবং সে দার্শনিক যখন কার্ল মার্ক্স
তখন তাঁর নাম বাদ দিয়ে তাঁর দর্শন নিয়ে আলোচনা চলেনা। তেমনই ভাবে বিভিন্ন দেশে
যঁদের নেতৃত্বে সে দর্শনের প্রয়োগ আংশিক ও সাময়িক সময়ের জন্যও সাফল্য লাভ করেছে
সেই নেতৃত্ব ও সেই দেশে তাঁদের অনুসৃত পথ প্রসংগে আলোচনাও বাদ দেয়া যায় না।
উপরন্তু যেহেতু এ দর্শন সর্বশেষ বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্বদর্শন এবং এ যুগে যখন
সার্বিক ভাবে একই ধাঁচের বিশ্ব-অর্থনীতি, রাজনীতি প্রবাহিত হচ্ছে তখন তা থেকে
বিচ্ছিন্ন করে এই দর্শন নিয়ে আলোচনা করা ও পথ নির্ণয় করা সম্পূর্ণ হয়না, সার্থক
হয়না। সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি পুঁজি, উৎপাদনের হাতিয়ার, উৎপাদন ও উৎপন্ন দ্রব্যের
সাথে মানুষের বিবিধ সম্পর্কের গুণগত চরিত্র বিশ্বব্যাপী এক। এ যুগে উৎপাদিত উপকরণ, তার বৈশিষ্ট্য, ব্যবহারের চরিত্র ও নির্ভরতা
বিশ্বব্যাপী ব্যাবহারিক ঐক্য স্থাপন করেছে। এই ঐক্যের পরিধির বাইরে গিয়ে মহামতি
মার্ক্সের বিশ্ব-দর্শনের আলোচনা ও প্রয়োগ অসম্পুর্ণ থেকে যায়।
এতদ্সত্ত্বেও একটি দেশে এ দর্শনের প্রায়োগিক
প্রক্রিয়া নির্ধারণের আলোচনার সময় অবশ্যই সে দেশের ভৌগলিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক,
সাংস্কৃতিক ও উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদির বিচার যথাযথ গুরুত্ব সহকারেই করতে হবে। এক
কথায় বললে বলতে হয় বিশ্ব ও দেশীয় উভয় বৈশিষ্ট্যই মার্ক্সীয় বিশ্বদর্শনের নিরিখে
বিচার বিশ্লেষণ করেই আমাদের পথ আমাদের ঠিক
করতে হবে।
[[ চলবে ]]
আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।
আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।
No comments:
Post a Comment