প্রাথমিক কথা

প্রাথমিক কথা

FOR YOUR COMMENTS

Click "[_] commetns:" at bottom of Post

Tuesday, June 24, 2014



আমরা কোথায় যাব ? --৪

আগের অনুচ্ছেদে যেখানে আমরা কথা শেষ করেছি সেখান থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আমাদের লক্ষ্য ও পথ নির্ণয়ের প্রয়োজনে আমরা অবিচ্ছেদ্যরূপে সুস্পষ্ট দুটি প্রেক্ষিত পাই। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত ও দেশীয় প্রেক্ষিত। আমাদের সময়তে বিশ্বব্যবস্থা সব দেশ-মহাদেশ-উপমহাদেশে এই দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক ও নির্ভরতা রেখেই শুধু টিঁকে আছে তাই নয়, এগিয়েও চলেছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে এখন আমরা যা দেখছি ও ভবিষ্যত সম্পর্কে মার্ক্সীয় দর্শনে যে অনিবার্য সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, সেই সমগ্র পর্যায়কে চরিত্র অনুসারে আমরা প্রধাণত দুই বিপরীতমুখী পরিচিতিতে ভাগ করতে পারি এবং এই দুই পরিচিতির প্রতিটিকে আমরা দুই প্রধাণ পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।

প্রথম যে দুই বিপরীতমুখী পরিচিতি, তার একটি হল, রাষ্ট্রীয় মালিকানা বহির্ভূত বা সর্বজনীন সামাজিক মালিকানা বহির্ভূত অসরকারি উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যাকে মার্ক্স চিহ্ণিত করেছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থারূপে। সেখানে উৎপাদন, বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ, বণ্টন সহ সমগ্র ব্যবস্থায় ব্যক্তিপুঁজিই মূল নিয়ন্ত্রক। আধুনিক যুগে বড় বড় শিল্পে একজন ব্যক্তির পুঁজির পরিবর্তে কয়েকজন পুঁজিপতির ও শেয়ার হোল্ডারের সম্মিলিত একটি কর্পোরেট সংস্থা সেসবের মালিক। উৎপাদন, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, বণ্টন বা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অধিক পুঁজির মালিকদের পছন্দ অনুযায়ী গঠিত একটি ম্যানেজিং বোর্ড। আমাদের দেশে কয়েক দশক আগে রাষ্ট্রীয় উদ্যগ, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, কয়েকটি শিল্প অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেসব ক্ষেত্রে পুনরায় অংশিদারী বিক্রী করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। কোন কোন উদ্যোগে সরকারী অংশিদারী কমিয়ে অসরকারি অংশিদারীর অনুপাত বাড়ানো হয়েছে। এমনকি বীমা, ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জ্বালানি উৎপাদন, পথঘাট ইত্যাদি পরিকাঠামো নির্মাণ, কৃষি-পণ্য উৎপাদন ও বিক্রী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে শুধু দেশীয় ব্যক্তি পুঁজি নয় বিদেশি লগ্নী পুঁজি ও বিদেশী ব্যক্তি পুঁজির প্রবেশের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। সরকারি অংশিদারিত্বের চাইতে বেশি হচ্ছে অসরকারী অংশিদারিত্ব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০% বিদেশী লগ্নি অনুমোদন করা হয়েছে।

এ ব্যবস্থায় কখনো কখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে রাষ্ট্র ততটুকুই নিয়ন্ত্রণ করে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ পুঁজির স্বার্থে প্রয়োজন। ব্যক্তপুঁজি যখনই সংকটে পড়ে রাষ্ট্র তাকে বাঁচিয়ে তলতে এগিয়ে আসে, আবার যখনই তারা সংকট কাটিয়ে ওঠে তখনই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়। একে দুটি ভাগে ভাগ করলে আমরা পাই একটি চরম অবস্থা যা ফ্যাসিজম নামে পরিচিত। ফ্যাসিজমের নমনীয় রূপ হল সাম্রাজ্যবাদ ও তার আগ্রাসী নীতি। দ্বিতীয় পাই পুঁজিবাদি ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলোর গণতন্ত্র যা পুঁজিবাদের নমনীয় রূপ। এই গণতন্ত্র যতক্ষণ পুঁজির স্বার্থে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় ততক্ষণই টিঁকে থাকে। মানুষ এই গণতন্ত্রকে ব্যবহার ক’রে পুঁজিবাদের কাছ থেকে, আপাতভাবে সরকারের কাছ থেকে নিজের স্বার্থ পূরণ করতে চায়। পুঁজির সংকট ও পুঁজিবাদীর অনীহার কারণে এই স্বার্থ পূরনের প্রচেষ্টা যখন পুঁজির মালিক বনাম পুঁজিহীন মানুষের সংঘাতের রূপ নেয়, সংঘাত চরমে পৌঁছয় তখন পুঁজির মালিক ও সরকার তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন বলে মনে করে এবং তখন তারা এই গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে, স্বৈরতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করে। এ অবস্থায় পুঁজিবাদ কখনো কখনো হিংস্র ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে, যে হিংস্রতা ও আগ্রাসী মনোভাব ফ্যাসিজমের প্রাণ।

উপরিল্লিখিত ব্যবস্থার বিকল্প বা দ্বিতীয়টি হল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উৎপাদন নীতি ও অর্থনীতি যার লক্ষ্য এমন এক ব্যবস্থার অভিমুখে যেখানে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, তা থেকে উৎপাদিত উপকরণ, বণ্টণ ও বাজার সহ সামগ্রিক অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে সর্বজনীন সামাজিক সমিতির মালিকানাধীন--- যেখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই লোপ পায়। এক কথায় শ্রেণীহীন, শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বরূপী রাষ্ট্রহীন সমাজ ব্যবস্থা, সাম্যবাদী সমাজ বা সাম্যবাদী অর্থনীতি। মার্ক্স–এর ব্যাখ্যায় যা আদিম যুগের যূথবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের আধুনিক রূপ বা বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী সমাজ। মার্ক্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই সাম্যবাদী সমাজের দুটি স্তর। একটি নিম্নতর স্তর ও অপরটি উচ্চতর স্তর।  সে ব্যাখ্যা অনুযায়ী নিম্নতর স্তরে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটবে না। যেহেতু এখানে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটেনা সেহেতু এখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে এবং সে রাষ্ট্র হবে সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের রাষ্ট্র। সেখানে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটানোর প্রক্রিয়া চলবে, যে প্রক্রিয়ার ফলে পুঁজিপতি শ্রেণীর বা পুঁজির ব্যক্তিমালিকানার অবলুপ্তি ঘটবে, ফলে সর্বহারা শ্রেণীরও অবলুপ্তি ঘটবে এবং সমাজ উচ্চতর সাম্যবাদী সমাজে উন্নীত হবে। সেখানে যেহেতু শ্রেণীর কোন অস্তিত্ব থাকবে না, সেহেতু রাষ্ট্রেরও কোন অস্তিত্ব থাকবে না। সমাজ পরিচালিত হবে একটি সমিতির দ্বারা।

এ প্রসংগে ইস্তেহারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মার্ক্স লিখছেন... ... “আগে আমরা দেখেছি যে, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের প্রথম ধাপ হ’ল প্রলেতারিয়েতকে শাসকশ্রেণীর অবস্থানে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করা।

(এই প্রথম পর্যায়ে) বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমে ক্রমে সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসকশ্রেণীরূপে সংগঠিত প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য এবং উৎপাদন-শক্তির মোট পরিমাণকে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রলেতারিয়ে তার রাজনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করবে। ( এই বিষয়টি অন্ত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ )

শুরুতে অবশ্যই সম্পত্তির অধিকার এবং বুর্জোয়া উতপাদন-অবস্থার ঊপর স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপ ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন হতে পারেনা ; সুতরাং তা করতে হবে এমন সব ব্যবস্থা মারফত, যা অর্থনীতির দিক থেকে অপর্যাপ্ত ও অযৌক্তিক মনে হবে, কিন্তু আন্দোলনের পথে এরা নিজ সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পুরানো সমাজ-ব্যবস্থার উপর আরও আক্রমণ প্রয়োজনয় করে তুলবে। উৎপাদন- পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপ্লবীকরণের উপায় হিসবে যা অপরিহার্য”। মার্কস-এঙ্গেলসের ব্যাখ্যায় এটা হ’ল সাম্যবাদের নিম্নতর স্তর।

মার্ক্স ঐ অধ্যায়েই এর পরিণতি ব্যাখ্যায় লিখেছেন.. ... “ বিকাশের গতিপথে যখন শ্রেণী-পার্থক্য অদৃশ্য হয়ে যাবে, সমস্ত উৎপাদন যখন গোটা জাতির এক বিশাল সমিতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে তখন সরকারী শক্তির রাজনৈতিক চরিত্র আর থাকবে না। সঠিক অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা হ’ল এক শ্রেণীর উপর অত্যাচার চালাবার জন্য অপর শ্রেণীর সংগঠিত শক্তি মাত্র। বুর্জোয়াশ্রেণীর সংগে লড়াই-এর ভিতর অবস্থার চাপে প্রলেতারিয়েত নিজেকে শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত করতে বাধ্যা হয়, বিপ্লবের মাধ্যমে তারা যদি নিজেদের শাসকশ্রেণীতে পরিণত করে ও শাসকশ্রেণী হিসাবে উৎপাদনের পুরাতন ব্যবস্থাকে তারা যদি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে, তাহলে সেই পুরানো অবস্থার সংগে সংগে শ্রেণীবিরোধ তথা সবরকম শ্রেণীর অস্তিত্বটাই দূর করে বসবে এবং তাতে করে শ্রেণী হিসাবে স্বীয় আধিপত্যেরও অবসান ঘটবে।

শ্রেণী ও শ্রেণী-বিরোধ-সম্বলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এক সমিতি, যার মধ্যে প্রত্যেকের স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত”। ( মার্ক্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটাই হ’ল সাম্যবাদের উচ্চতর স্তর। )


[ চলবে ]

Tuesday, June 10, 2014


আমরা কোথায় যাব ? --৩

মতাদর্শের প্রশ্নে আমাদের এখানকার পার্টিগুলোর অবস্থান জন্মলগ্ন থেকেই বড় অদ্ভূত !

প্রায়সই একটা কথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনীতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন এমন মানুষের কাছ থেকে শোনা যায় যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, আন্দোলন ও বিপ্লব ভারতীয় বৈশিষ্টের মধ্যেই থাকতে হবে। বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষিতে বা কোনো দেশের অনুকরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে হবে না। এ জাতিয় কথায় যথেষ্ট সারবত্তা থাকলেও এ প্রশ্ন উত্থাপন করা অত্যন্ত সংগত যে, আন্তর্জাতিক বিপ্লবী ঘটনাবলি ও বিশ্বদর্শন বাদ দিয়ে কি সাম্যবাদী বিপ্লবের ভাবনা, পরিকল্পনা, প্রয়োগ সম্ভব ? আমাদের তো ঠিক করতে হবে, আমরা কি শ্রমিক কৃষক ও সমাজের অন্যান্য অংশের সমস্যা-জর্জরিত মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার আশু ও আংশিক সমাধান দাবীর আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছি ? অথবা আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি এই সমস্যা সমুহের চূড়ান্ত সমাধানের আশায়, যে ব্যবস্থা এর মূলে রয়েছে তাকেই উৎপাটিত করে নতুন এক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বকালেই অগ্রসর হব ? নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় কোনো মানুষই প্রথম পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইবেন না। যাঁরা প্রথম পর্যায়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান তাঁরা অন্য কোনো দর্শনের কথা চিন্তা করার চাপ নিতে চাইবেন না। কারণ, হয় তাঁরা প্রকৃত অর্থে বোঝেনই না যে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে তাঁদের সমস্যার বীজ অথবা বুঝেও এই ব্যবস্থার সাথে আপস করে চলতে চান। তাঁরা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই কিছুদিন এক অংশকে ক্ষমতায় বসানোর পর আবার আরেক অংশকে ক্ষমতাসীন করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা তৃতীয় কোন শক্তির সন্ধান করে। সে জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেন। দীর্ঘ অপেক্ষায় তাঁরা এতটাই ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন যে, প্রথমে তাঁরা আঞ্চলিকভাবে ছোট ছোট সংগঠন গড়ে তোলেন এবং কিছুদিন পরে বর্তমান শক্তিগুলির মধ্য থেকেই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে অপর একটি নতুন জোট গড়ে ওঠে এবং মানুষের আস্থা অর্জন করে। ক্রমাগত এই অবস্থার আবর্তন-প্রত্যাবর্তন চলতেই থাকে। আমাদের দেশে ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে এই অস্থিরতা বেশি বেশি করে দেখা যাচ্ছে। জনগণ তো বটেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৃহদংশের চেতনাও এর চাইতে উন্নীত হতে পারেনি। এর প্রমাণ আমরা পাই প্রায় সব রাজ্যেই কখনও স্থানীয় দাবীকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের পর, আবার কখনও অন্য রাজনৈতিক দলের বিরোধীতা করেই এক বা একাধিক আঞ্চলিক দল গড়ে ওঠার মধ্যে। পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় স্তরে এই আঞ্চলিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ক’রে ক্ষমতা ভাগাভাগি ক’রে একটি সর্বভারতীয় জোটে সম্মিলিত হন। কিন্তু তাঁরা কখনই এই ব্যবস্থাটাকে ভাঙ্গতে চাননা, বরং নানাবিধ স্বার্থের সঙ্ঘাতে তাঁদের নিজেদেরই সেই জোট ভেঙে যায়। এদিক ওদিক সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও মূলত সাধারণ মানুষের দুর্দশা চলতেই থাকে।

সামজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চিন্তার ধারে কাছেও ঘেঁষেন না, শুধুমাত্র আধ্যাত্মবাদী মত ও পথেই থাকেন এমন মানুষের সংখ্যা এতই কম যে তাঁদের দর্শন নিয়ে আলোচনা এখানে অপ্রাসংগিক। তবু নিজ নিজ ধর্মে গভীর বিশ্বাস রাখেন আবার সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করেন এমন মানুষের সংখ্যা যেহেতু সর্বাধিক তাঁদের প্রসংগেও আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। নির্দ্বিধায় বলা যায় তাঁরা এক অদ্ভূত দ্বৈত মানসিকতার মানুষ। তাঁরাও উপরে আলোচিত আবর্তন-প্রত্যাবর্তনের অতিরিক্ত চিন্তা ও কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে উন্নীত নন।

উপরের এই দুই ধরণের মানসিকতার কথা বাদ দিলে তৃতীয় যে দর্শন তার উদ্ভব যেহেতু ভারতবর্ষের বাইরে এবং সে দার্শনিক যখন কার্ল মার্ক্স তখন তাঁর নাম বাদ দিয়ে তাঁর দর্শন নিয়ে আলোচনা চলেনা। তেমনই ভাবে বিভিন্ন দেশে যঁদের নেতৃত্বে সে দর্শনের প্রয়োগ আংশিক ও সাময়িক সময়ের জন্যও সাফল্য লাভ করেছে সেই নেতৃত্ব ও সেই দেশে তাঁদের অনুসৃত পথ প্রসংগে আলোচনাও বাদ দেয়া যায় না। উপরন্তু যেহেতু এ দর্শন সর্বশেষ বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্বদর্শন এবং এ যুগে যখন সার্বিক ভাবে একই ধাঁচের বিশ্ব-অর্থনীতি, রাজনীতি প্রবাহিত হচ্ছে তখন তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই দর্শন নিয়ে আলোচনা করা ও পথ নির্ণয় করা সম্পূর্ণ হয়না, সার্থক হয়না। সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি পুঁজি, উৎপাদনের হাতিয়ার, উৎপাদন ও উৎপন্ন দ্রব্যের সাথে মানুষের বিবিধ সম্পর্কের গুণগত চরিত্র বিশ্বব্যাপী একএ যুগে উৎপাদিত উপকরণ, তার বৈশিষ্ট্য, ব্যবহারের চরিত্র ও নির্ভরতা বিশ্বব্যাপী ব্যাবহারিক ঐক্য স্থাপন করেছে। এই ঐক্যের পরিধির বাইরে গিয়ে মহামতি মার্ক্সের বিশ্ব-দর্শনের আলোচনা ও প্রয়োগ অসম্পুর্ণ থেকে যায়।

এতদ্‌সত্ত্বেও একটি দেশে এ দর্শনের প্রায়োগিক প্রক্রিয়া নির্ধারণের আলোচনার সময় অবশ্যই সে দেশের ভৌগলিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদির বিচার যথাযথ গুরুত্ব সহকারেই করতে হবে। এক কথায় বললে বলতে হয় বিশ্ব ও দেশীয় উভয় বৈশিষ্ট্যই মার্ক্সীয় বিশ্বদর্শনের নিরিখে বিচার  বিশ্লেষণ করেই আমাদের পথ আমাদের ঠিক করতে হবে।

[[ চলবে ]]

আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।



Friday, June 6, 2014


আমরা কোথায় যাব ? –২

“জাতীয় দল”-এই স্বীকৃতি পাওয়া ও তা ধরে রাখার প্রচেষ্টা প্রসংগ ঃ-

সংসদীয় গণতন্ত্রে অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় দলের বিশেষ মর্যাদা ও অগ্রাধিকার আছে। বিশেষত নির্বাচনের সময়ে সব রকম কর্মকাণ্ডেই জাতীয় দলগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। প্রার্থীর প্রতীক বিতরণ থেকে শুরু করে ভোটার লিষ্ট পাওয়া, সভা করা, বুথ এজেণ্টদের এবং কাউণ্টিং এজেণ্টদের সামনের সারিতে বসার অগ্রাধিকার এই দলগুলো পায়। জাতীয় দলের পর সুযোগ পায় আঞ্চলিক দল, তারপর নির্দল। সেজন্যে সব রাজনৈতিক দলই নিজেদের এই জাতীয় দলের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য সচেষ্ট হয়। কমিউনিস্ট বলে স্বঘোষিত পার্টিগুলোও এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকে। দীর্ঘ অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই সচেতনতা একটা প্রধাণ বিষয় হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই স্বীকৃতি একটা গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাম পার্টিগুলোও এই গর্বে গর্বিত। স্বতসিদ্ধভাবেই এই স্বীকৃতি ধরে রাখার জন্যও তারা সর্বদা সচেষ্ট থাকে এবং প্রয়োজনে বিবিধ কৌশল অবলম্বন করে। যে কথা সব সময়ে মনে রাখা প্রয়োজন, তা মনে রাখা হয় না।

১।     নির্বাচন কমিশন জাতীয় দলের স্বীকৃতি দিলেই দেশের মানুষের কাছে জাতীয় দলের স্বীকৃতি পাওয়া যায় না, সমগ্র জাতির দল হওয়া যায়না।

২।    রাজ্যভিত্তিক ভোটের এবং প্রাপ্ত আসনের সামান্য হেরফেরেই নির্বাচন কমিশনের দেয়া জাতীয় দল-এর স্বীকৃতি বাতিল হয়ে যায়।

৩।    প্রকৃত জাতীয় দলের স্বীকৃতি নির্বাচন কমিশন বা সরকার না দিলেও দেশ শুদ্ধু মানুষের মনে থেকে যায়।

৪। অন্য রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে দুয়েকটি আসন বোঝাপড়াকে আমি মনে করি জাতীয় দলের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যেই এই বোঝাপড়ার চেষ্টা। বিনিময়ে তাঁদের কেউ কেউ বামেদের শক্তি যেখানে বেশি সেখানে দুতিনটি আসন দাবী করেন। অন্য রাজ্যে এভাবেই পাওয়া কয়েকটি আসন ( অর্জন বা জয়লাভ বলব না) যোগাড় করাকে নেতৃত্ব সে রাজ্যে সংগঠনের বিস্তার ঘটেছে বলে ফলাও প্রচার করেন কিন্তু পরের নির্বাচনে দেখা যায় ফল উল্টো হয়েছে। এই ফাঁকিবাজি বোঝাপড়া অর্থহীন ও সুবিধাবাদের পরিচায়ক, আসল কাজে বা লক্ষ্য সাধনে নিস্ক্রিয়তার পরিচায়ক। ২০১৪-তে জয়ললিতা যখন প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, তাঁরা একটি আসনও কাউকে ছাড়বেন না তখন আসন চাইতে যাওয়া দলটির সর্বভারতীয় মর্যাদা কোথায় থাকে ?

এই আঞ্চলিক দলগুলো সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো নীতি নিয়ে চলে না। নিজেদের রাজ্যে শক্তি সঞ্চয়, জাত্যাভিমান ও নানা রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তের ভয়ে এরা সর্বদাই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের সাথে থাকে।

এতসবের পরেও প্রকৃতভাবে মানুষের মনে জাতীয় দলের স্থান অর্জনের প্রচেষ্টাকে সরিয়ে দিয়ে এই সহজে চটজলদি কিছু জুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। বৃহত্তর গণ আন্দোলনকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে এটা কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক কৌশল হতে পারেনা। বরং বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।


[[ চলবে ]]

আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।

Tuesday, June 3, 2014





আমরা কোথায় যাব ? --১ 


[[ ভাবতে যখন শুরু  করি তখন এলোমেলো ভাবে অনেক কথা চলে আসে, স্মরণ শক্তির অভাবে সেগুলো অনেক সময়ে ভুলে যাই। তাই লেখাটা কিছুটা অগোছাল হতে পারে, আগের কথা পরে, পরের কথা আগে চলে আসতে পারে। ]]

আমরা কোথায় যাব ? --১ 

আমার ভাবনা ঠিক এখন এই সময়তে এভাবে প্রকাশ করায় ভুল বোঝার যথেষ্ট সম্ভাবনা ও সুযোগ আছে। ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচন থেকে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত সবকটি নির্বাচনে সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকারী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে ঘোষিত ও পরিচিত পার্টিগুলির পরাজয়ের যা বহর, তারপর মনে হতেই পারে যে, এই পরাজয়ের ফলেই আমি এসব বলছি। তা যে নয় সে কথা আমার পরিচিত জনেরা জানেন। বিশেষত ২০১৪-র নির্বাচনের পর এই দলগুলোর অভ্যন্তরে যে কথাবার্তা-শোরগোল চলছে তারপর আশাকরি আমার এই কথায় কেউ ভুল বুঝবেন না।

কোথায় আর বলব, শোনে তো না কেউ। শোনার ইচ্ছে এবং ধৈর্য কারও নেই। তাই অনেক দ্বিধা সত্ত্বেও এখানেই শুরু করলাম।
       
      এই পার্টিগুলোকেও দেখি নির্বাচনে পরাজয়ের পর তাঁরা বিশ্লেষণ করতে বসেন। দোষ নেই। জয়ের পর তাঁরা এহেন বিশ্লেষণ করেননা, সোজা-সাপটা বলে দেন, ‘এ জয় তাঁদের সাফল্যের জয়। তাঁদের মতাদর্শ ও রাজনীতি যে সঠিক এই জয় তার প্রমাণ’।

       ২০০৯ নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে নেতৃত্ব বদলের। ২০১১-এ বিধানসভা নির্বাচনে চেষ্টা হল নতুন মুখকে প্রার্থী করার। ২০১৪-তেও এই বিষয়টাতেই গুরুত্ব দেয়া হল। পার্টির নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত সকলেই মনে করতে শুরু করলেন, নতুন মুখ আনলেই প্রার্থী জিতবে, কিন্তু কোনো স্তরের কেউ সাধারণ মানুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেননি। সে ইচ্ছেও তাঁদের ছিলনা। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে মানুষ তাঁদের সংগেই আছেন। নিচের তলার কর্মী এবং নেতারাও এ ব্যাপারে সতর্ক তো ছিলেনই না, অসতর্ক মুহূর্তেও তাঁরা মানুষের মুখের ভাষা পড়তে পারেন নি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে পারি অভিজ্ঞ মানুষেরা যাঁরা মানুষের মধ্যে থাকেন তাঁদের কিন্তু পরিবর্তনের আবহাওয়া বুঝতে অসুবিধে হয়নি, বরং একদম ঠিক ঠিক আভাস তাঁদের কাছে ছিল। তাঁরা সে কথা প্রকাশও করেছিলেন, কিন্তু সে কথা বিশ্বাস করার অবস্থাতেই কেউ ছিলনা।

       আসলে পরিবর্তন শুরু ভেতরে ভেতরে হয়েছিল আরও দু’দশক আগে থেকেই। প্রথম প্রকাশ এসে ঠেকল ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে। এই নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলের রায় থেকে সাহসের রোগ ছড়িয়ে পড়ল প্রায় সর্বত্র। পরবর্তি নির্বাচনে অপছন্দের ধাক্কা ধস নামিয়ে দিল।

২০১৪-র নির্বাচনের পর এ নিয়ে পার্টির উচ্চস্তরেনেতৃত্ব বদলের জন্য শোরগোল পড়ে গেছে। নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্ন যখন নানা মহলে এমনকি দলের অভ্যন্তরেও উঠেছে তখন একথা স্পষ্টভাবে বলা উচিত কেন পরিবর্তন ? কেবলমাত্র নির্বাচনে পরপর পরাজয়ের জন্য ?

যদি তাদের কর্মক্ষমহীনতার কথা ওঠে তবে তা আরো আগেই ওঠা উচিত ছিল। যদি অযোগ্যতার কথা ওঠে তবে প্রশ্ন, নেতৃত্ব তো আকাশ থেকে আসেন না। দীর্ঘ কাজের মধ্য দিয়ে যাচাই করে তাঁদের আনা হয়। তা হলে সেই যাচাইয়ে কি ভুল ছিল কোথাও ? শুধু নেতৃত্ব বদলই কি সমাধান ? প্রশ্ন উঠেছে কমিটি ভেঙে দেয়ার, তাহলে তো গোটা পার্টিটাকেই ভেঙে দিতে হয়! একজন, দুজন, তিনজন নেতা বা নেত্রী কর্মক্ষমতা হারাতে পারেন, ভুল করতে পারেন কিন্তু নেতৃত্বের বাকি বড় অংশ কী করছিলেন ?

আসল কথা হল, কর্মক্ষম যোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্য কমিটি, উপযুক্ত পার্টি সবই হতে পারে যদি মতাদর্শ ঠিক থাকে এবং মতাদর্শকে রূপায়িত করার জন্য সৎ ও সচেতন ধারাবাহিক কর্মপ্রবাহ থাকে। শুধু রুটিন মাফিক ধরাবাঁধা কিছু কাজ দিয়ে হয়না। আপনাদের দলগুলোতে তা ছিল কি ?  মতাদর্শের বাস্তব রূপায়নের জন্য কিছু কিছু কথা মাঝে মাঝে উচ্চারণ করা হলেও কার্যত কিছুই হয়নি। সেই বিচারে মতাদর্শ সম্পর্কে যে কোনো স্তরের নেতৃত্ব কতটা সচেতন ছিলেন, রূপায়নের প্রশ্নে কতটা সৎ ও আন্তরিক ছিলেন সে প্রশ্ন দেখা দেয়।


এসব বাদ দিয়ে যদি নীতি ও মতাদর্শের কথা ওঠে তাহলে আমার মনে পড়ছে চীনের একাদশ পার্টি কংগ্রেসের পর সেখানকার কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছিল, ‘ কমরেড মাও-সে-তুং ওয়াজ রাইট বাট আওয়ার সেন্ট্রাল কমিটি ওয়াজ রং। একথা পিপলস ডেমোক্রেসিতে আমি পড়েছি। পুরো পার্টি নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের একথা প্রসংগে অন্য আলোচনা এখানে অপ্রাসংগিক। চিনের সমস্যার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি একা মাও-সে-তুং কে দায়ী করেননি। এটাই তো হওয়া উচিত। আমাদের এখানে পার্টির অভ্যন্তরে যাঁরা নেতৃত্ব বদলের কথা বলছেন তাঁরা সে বদলথেকে নিজেদের বাদ রাখছেন কেন ? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁদের এসব কথার নেপথ্যে মানুষের স্বার্থ চিন্তা নেই, পার্টির স্বার্থ চিন্তা নেই, আছে অন্য কিছু অথবা ভ্রান্তি। 

[ চলবে ]

আপনার মন্তব্যের জন্য নিচে "No Comments:" Click করুন।