আমরা কোথায় যাব ? --৪
আগের অনুচ্ছেদে যেখানে আমরা কথা শেষ করেছি সেখান
থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আমাদের লক্ষ্য ও পথ নির্ণয়ের প্রয়োজনে আমরা
অবিচ্ছেদ্যরূপে সুস্পষ্ট দুটি প্রেক্ষিত পাই। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত ও দেশীয়
প্রেক্ষিত। আমাদের সময়তে বিশ্বব্যবস্থা সব দেশ-মহাদেশ-উপমহাদেশে এই দুয়ের মধ্যে
সম্পর্ক ও নির্ভরতা রেখেই শুধু টিঁকে আছে তাই নয়, এগিয়েও চলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে এখন আমরা যা দেখছি ও
ভবিষ্যত সম্পর্কে মার্ক্সীয় দর্শনে যে অনিবার্য সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, সেই
সমগ্র পর্যায়কে চরিত্র অনুসারে আমরা প্রধাণত দুই বিপরীতমুখী পরিচিতিতে ভাগ করতে
পারি এবং এই দুই পরিচিতির প্রতিটিকে আমরা দুই প্রধাণ পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।
প্রথম যে দুই বিপরীতমুখী পরিচিতি, তার একটি হল,
রাষ্ট্রীয় মালিকানা বহির্ভূত বা সর্বজনীন সামাজিক মালিকানা বহির্ভূত অসরকারি
উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যাকে মার্ক্স চিহ্ণিত করেছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থারূপে।
সেখানে উৎপাদন, বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ, বণ্টন সহ সমগ্র ব্যবস্থায় ব্যক্তিপুঁজিই মূল
নিয়ন্ত্রক। আধুনিক যুগে বড় বড় শিল্পে একজন ব্যক্তির পুঁজির পরিবর্তে কয়েকজন
পুঁজিপতির ও শেয়ার হোল্ডারের সম্মিলিত একটি কর্পোরেট সংস্থা সেসবের মালিক। উৎপাদন,
উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, বণ্টন বা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অধিক পুঁজির মালিকদের পছন্দ
অনুযায়ী গঠিত একটি ম্যানেজিং বোর্ড। আমাদের দেশে কয়েক দশক আগে রাষ্ট্রীয় উদ্যগ,
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, কয়েকটি শিল্প অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেসব
ক্ষেত্রে পুনরায় অংশিদারী বিক্রী করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার অনুপ্রবেশ ঘটানো
হচ্ছে। কোন কোন উদ্যোগে সরকারী অংশিদারী কমিয়ে অসরকারি অংশিদারীর অনুপাত বাড়ানো
হয়েছে। এমনকি বীমা, ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জ্বালানি উৎপাদন, পথঘাট ইত্যাদি
পরিকাঠামো নির্মাণ, কৃষি-পণ্য উৎপাদন ও বিক্রী, স্বাস্থ্য,
শিক্ষা প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে শুধু দেশীয় ব্যক্তি পুঁজি নয় বিদেশি লগ্নী পুঁজি ও
বিদেশী ব্যক্তি পুঁজির প্রবেশের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। সরকারি অংশিদারিত্বের চাইতে
বেশি হচ্ছে অসরকারী অংশিদারিত্ব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০% বিদেশী লগ্নি অনুমোদন
করা হয়েছে।
এ ব্যবস্থায় কখনো কখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে
অর্থনীতিকে রাষ্ট্র ততটুকুই নিয়ন্ত্রণ করে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ পুঁজির স্বার্থে
প্রয়োজন। ব্যক্তপুঁজি যখনই সংকটে পড়ে রাষ্ট্র তাকে বাঁচিয়ে তলতে এগিয়ে আসে, আবার যখনই
তারা সংকট কাটিয়ে ওঠে তখনই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়। একে দুটি ভাগে ভাগ করলে
আমরা পাই একটি চরম অবস্থা যা ফ্যাসিজম নামে পরিচিত। ফ্যাসিজমের নমনীয় রূপ হল
সাম্রাজ্যবাদ ও তার আগ্রাসী নীতি। দ্বিতীয় পাই পুঁজিবাদি ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ
গুলোর গণতন্ত্র যা পুঁজিবাদের নমনীয় রূপ। এই গণতন্ত্র যতক্ষণ পুঁজির স্বার্থে বাধা
হয়ে না দাঁড়ায় ততক্ষণই টিঁকে থাকে। মানুষ এই গণতন্ত্রকে ব্যবহার ক’রে পুঁজিবাদের
কাছ থেকে, আপাতভাবে সরকারের কাছ থেকে নিজের স্বার্থ পূরণ করতে চায়। পুঁজির সংকট ও
পুঁজিবাদীর অনীহার কারণে এই স্বার্থ পূরনের প্রচেষ্টা যখন পুঁজির মালিক বনাম
পুঁজিহীন মানুষের সংঘাতের রূপ নেয়, সংঘাত চরমে পৌঁছয় তখন পুঁজির মালিক ও সরকার
তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন বলে মনে করে এবং তখন তারা এই গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে,
স্বৈরতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করে। এ অবস্থায় পুঁজিবাদ কখনো কখনো হিংস্র ও আগ্রাসী
হয়ে ওঠে, যে হিংস্রতা ও আগ্রাসী মনোভাব ফ্যাসিজমের প্রাণ।
উপরিল্লিখিত ব্যবস্থার বিকল্প বা দ্বিতীয়টি হল রাষ্ট্রীয়
মালিকানাধীন উৎপাদন নীতি ও অর্থনীতি যার লক্ষ্য এমন এক ব্যবস্থার অভিমুখে যেখানে
সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, তা থেকে উৎপাদিত উপকরণ, বণ্টণ ও বাজার সহ সামগ্রিক
অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে সর্বজনীন সামাজিক সমিতির মালিকানাধীন--- যেখানে রাষ্ট্রের
অস্তিত্বই লোপ পায়। এক কথায় শ্রেণীহীন, শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বরূপী রাষ্ট্রহীন সমাজ
ব্যবস্থা, সাম্যবাদী সমাজ বা সাম্যবাদী অর্থনীতি। মার্ক্স–এর ব্যাখ্যায় যা আদিম
যুগের যূথবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের আধুনিক রূপ বা বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী সমাজ।
মার্ক্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই সাম্যবাদী সমাজের দুটি স্তর। একটি নিম্নতর স্তর ও
অপরটি উচ্চতর স্তর। সে ব্যাখ্যা অনুযায়ী
নিম্নতর স্তরে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটবে না। যেহেতু এখানে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটেনা
সেহেতু এখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে এবং সে রাষ্ট্র হবে সর্বহারা বা শ্রমিক
শ্রেণির একনায়কত্বের রাষ্ট্র। সেখানে শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটানোর প্রক্রিয়া চলবে, যে
প্রক্রিয়ার ফলে পুঁজিপতি শ্রেণীর বা পুঁজির ব্যক্তিমালিকানার অবলুপ্তি ঘটবে, ফলে
সর্বহারা শ্রেণীরও অবলুপ্তি ঘটবে এবং সমাজ উচ্চতর সাম্যবাদী সমাজে উন্নীত হবে।
সেখানে যেহেতু শ্রেণীর কোন অস্তিত্ব থাকবে না, সেহেতু রাষ্ট্রেরও কোন অস্তিত্ব
থাকবে না। সমাজ পরিচালিত হবে একটি সমিতির দ্বারা।
এ প্রসংগে ইস্তেহারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মার্ক্স
লিখছেন... ... “আগে আমরা দেখেছি যে, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের প্রথম ধাপ হ’ল
প্রলেতারিয়েতকে শাসকশ্রেণীর অবস্থানে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত
করা।
(এই প্রথম পর্যায়ে) বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমে
ক্রমে সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসকশ্রেণীরূপে সংগঠিত
প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য এবং উৎপাদন-শক্তির
মোট পরিমাণকে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রলেতারিয়ে তার রাজনৈতিক
আধিপত্য ব্যবহার করবে। ( এই বিষয়টি অন্ত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ )
শুরুতে অবশ্যই সম্পত্তির অধিকার এবং বুর্জোয়া
উতপাদন-অবস্থার ঊপর স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপ ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন হতে পারেনা ;
সুতরাং তা করতে হবে এমন সব ব্যবস্থা মারফত, যা অর্থনীতির দিক থেকে অপর্যাপ্ত ও
অযৌক্তিক মনে হবে, কিন্তু আন্দোলনের পথে এরা নিজ সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পুরানো
সমাজ-ব্যবস্থার উপর আরও আক্রমণ প্রয়োজনয় করে তুলবে। উৎপাদন- পদ্ধতির সম্পূর্ণ
বিপ্লবীকরণের উপায় হিসবে যা অপরিহার্য”। মার্কস-এঙ্গেলসের ব্যাখ্যায় এটা হ’ল
সাম্যবাদের নিম্নতর স্তর।
মার্ক্স ঐ অধ্যায়েই এর পরিণতি ব্যাখ্যায় লিখেছেন..
... “ বিকাশের গতিপথে যখন শ্রেণী-পার্থক্য অদৃশ্য হয়ে যাবে, সমস্ত উৎপাদন যখন গোটা
জাতির এক বিশাল সমিতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে তখন সরকারী শক্তির রাজনৈতিক চরিত্র আর
থাকবে না। সঠিক অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা হ’ল এক শ্রেণীর উপর অত্যাচার চালাবার জন্য
অপর শ্রেণীর সংগঠিত শক্তি মাত্র। বুর্জোয়াশ্রেণীর সংগে লড়াই-এর ভিতর অবস্থার চাপে
প্রলেতারিয়েত নিজেকে শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত করতে বাধ্যা হয়, বিপ্লবের মাধ্যমে তারা
যদি নিজেদের শাসকশ্রেণীতে পরিণত করে ও শাসকশ্রেণী হিসাবে উৎপাদনের পুরাতন
ব্যবস্থাকে তারা যদি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে, তাহলে সেই পুরানো অবস্থার সংগে সংগে
শ্রেণীবিরোধ তথা সবরকম শ্রেণীর অস্তিত্বটাই দূর করে বসবে এবং তাতে করে শ্রেণী
হিসাবে স্বীয় আধিপত্যেরও অবসান ঘটবে।
শ্রেণী ও শ্রেণী-বিরোধ-সম্বলিত পুরানো বুর্জোয়া
সমাজের স্থান নেবে এক সমিতি, যার মধ্যে প্রত্যেকের স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন
বিকাশের শর্ত”। ( মার্ক্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটাই হ’ল সাম্যবাদের উচ্চতর স্তর। )
[ চলবে ]